কাগজের সংকটে দেশঃ নতুন বই আর পড়াশোনা নিয়ে আশঙ্কা

    0
    1298

    দেশের ব্যাংকিং খাত ও রিজার্ভ থেকে অর্থ চুরির কারণে সার্বিকভাবে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের উপর প্রভাব পড়েছে আরও আগেই। ধীরে ধীরে সেই সংকট ও প্রভাব এখন আরও প্রকট হচ্ছে। ডলার সংকটের প্রভাব এখন মুদ্রণ শিল্পের উপরও পড়েছে। আর এর ফলে দেশের গুরুত্বপূর্ন খ্যাত শিক্ষা ক্ষেত্রে মারাত্বক ক্ষতির আশংকা করা হচ্ছে।

    সম্প্রতি বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে উঠে আসে বাংলাদেশে ডলার সংকটের কারণে অন্য অনেক খাতের মতো প্রভাব পড়েছে দেশের মুদ্রণ শিল্পের ওপরেও। ফলে নতুন বই প্রকাশ আর পড়াশোনায় দরকারি সাদা কাগজের সংকট তৈরির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

    বাংলাদেশের রিজার্ভ সংকটের কারণে আর্থিক খাত নিয়ে অনাস্থা সৃষ্টি হয়েছে দেশে-বিদেশে। ফলে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর এলসি গ্রহণ করছে না অন্য দেশের ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতে তাই আমদানির জন্য এলসি খলা যাচ্ছে না – এই খবরও কিছুটা পুরনো।

    সাম্প্রতিক প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের করা এক নির্দেশনাপত্রের পরিপ্রেক্ষিতেও এর আসল চিত্র বুঝা যাচ্ছে। সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষায় ছাপানো প্রশ্ন না দিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে লিখে দেয়ার জন্য। শুধু তাই নয়, প্রশ্নের উত্তর লেখার জন্য কাগজও তাদের বাড়ি থেকে নিয়ে আসতে বলা হয়েছে।

    অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে এই নির্দেশনা দিয়ে দেশের সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। আর এতেই ফুতে উঠছে দেশে কাগজের সংকট কতটা প্রকট।

    প্রকাশক ও মুদ্রণ ব্যবসায়ীরা বলছেন, একদিনে বাজারে কাগজের দাম গত এক মাসের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। আবার আমদানি কম হওয়ায় ভালো মানের পর্যাপ্ত কাগজও বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না।

    ফলে তারা আশঙ্কা করছেন, এর ফলে একদিনে যেমন বছরের শুরুতে স্কুলগুলোর পাঠ্যপুস্তক হাতে পাওয়া নিয়ে সমস্যা তৈরি হতে পারে, আরেকদিকে বই মেলার অনেক বইয়ের প্রকাশ আটকে যেতে পারে।

    কী জটিলতা তৈরি হয়েছে?

    বাংলাদেশে পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সহ-সভাপতি শ্যামল পাল জানায়, “বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্প গুরুতর একটা সংকটে পড়েছে। এটা এখনি সমাধান করা না গেলে সামনের বছর শুধু প্রাথমিকের বিনামূল্যের ৩০ লাখ বই নয়, অন্যান্য ক্লাসের, নাইন-টেনের, ইন্টারমিডিয়েটের- সব বই পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে যাবে।”

    প্রকাশকরা জানাচ্ছেন, অগাস্ট থেকেই বাজারে কাগজের সংকট শুরু হয়েছে, এখন সেটা গুরুতর অবস্থায় পৌঁছেছে। এর মধ্যেই কাগজের রিমের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এমনকি বেশি টাকা দিয়েও কাগজ পাচ্ছেন না অনেক প্রকাশক।

    তিনি জানিয়েছেন, তিনমাস আগেও যে কাগজের রিম ১৫০০ টাকায় পাওয়া যেতো, তা এখন চার হাজার টাকা ছাড়িয়ে গেছে।

    ফলে গত কয়েক বছর ধরে জানুয়ারির শুরুতে প্রাথমিকে যে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হয়, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। অনেক প্রকাশক জানিয়ে দিয়েছেন, কাগজ সংকট ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে তারা ঠিক সময়ে বই সরবরাহ করতে পারবেন না।

    ব্যবসায়ীরা বলছেন, কাগজ সংকটের সমাধান না হলে প্রভাব পড়তে পারে শিক্ষার্থীদের ওপরেও। পাশাপাশি অন্যান্য পাঠ্যপুস্তকের দাম আগের তুলনায় দেড় থেকে দুইগুণ বেড়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছেন প্রকাশকরা। সেই সঙ্গে স্কুল-কলেজের পড়াশোনায় প্রয়োজনীয় সাদা কাগজের অভাব বা দাম অনেক বেড়ে যাওয়ারও ইঙ্গিত দিচ্ছেন তারা।

    কারণ বছরের শেষ দিকে নানা বই ছাপানো, ক্যালেন্ডার-ডায়েরি থেকে শুরু করে মুদ্রণ খাতে কাজ বেড়ে যায়।

    শ্যামল পাল বলছে, “আমাদের র’-ম্যাটেরিয়াল নেই, বিদ্যুৎ নেই। নতুন বছরে ডজন ডজন খাতা লাগবে। আরও বিভিন্ন খাতে কাগজ লাগে বাংলাদেশে; ইমপোর্টও হচ্ছে না। এখন কাগজ যা আছে, তা দিয়ে হয়তো আর কিছুদিন চলবে। কিন্তু দ্রুত কাগজ উৎপাদন বা আমদানি করা না গেলে ভয়াবহ সংকটে পড়তে হবে আমাদের।”

    অন্যদিকে বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতের বড় একটি ব্যবসার সময় অমর একুশে বই মেলা। আগামী প্রকাশনীর প্রকাশক ওসমান গনি বলছেন, “কাগজের এই সংকট অব্যাহত থাকলে বইমেলাতে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা অনেক কমে যাবে। আর যেভাবে কাগজের দাম বেড়েছে, বইয়ের দামও অনেক বেশি হয়ে যাবে।”

    কুমিল্লার একজন বইপত্র ব্যবসায়ী আব্দুল হান্নান বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “আমার এখানে কাগজের যে চাহিদা, তার তিনভাগের একভাগ কাগজও পাচ্ছি না। সমস্যা এই রকম থাকলে স্কুল-কলেজের নতুন ক্লাস শুরু হলে কাউকে কাগজ আর দিতে পারবো বলে মনে হয় না।”

    বাংলাদেশে মূলত দুই ধরনের কাগজ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বইপত্র ছাপানো বা পড়াশোনার কাজে হালকা কাগজ ব্যবহৃত হয়। এর পুরোটাই দেশীয় কারখানায় উৎপাদিত হয়। এই খাত সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছে।

    অন্যদিকে ক্যালেন্ডার, প্যাকেজিং বা গার্মেন্টস শিল্পে ভারী কাগজ দরকার হয়। এটা দেশের বাইরে থেকে আমদানি করা হয়ে থাকে।

    কিন্তু এখন বাজারে উভয় ধরনের কাগজের সংকট তৈরি হয়েছে।

    বাংলাদেশে লেখা ও ছাপার জন্য বছরে ১০ লাখ টন কাগজের চাহিদা রয়েছে। এর বেশিরভাগটা দেশে উৎপাদিত হয়।

    দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা দিতে বাইরে থেকে সরাসরি প্রিন্টিং পেপার আমদানির সুযোগ নেই। তবে কাগজ তৈরির উপকরণ পাল্প আমদানি করা হয়। সেই সঙ্গে ভারী কাগজ আমদানি করার অনুমতি দেয়া হয়।

    আর কিছু কাগজ পুরনো বইপত্র-পেপার রিসাইকল করে তৈরি করা হয়।

    বাংলাদেশে ২০৬টি পেপার মিল রয়েছে, যার মধ্যে চালু রয়েছে প্রায় ৮০টি কারখানা। লেখা ও ছাপার কাগজের কাজ করে মাত্র ৩০ থেকে ৩৫টি কারখানা।

    আম্বার পেপার মিলস লিমিটেডের পরিচালক মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান বিবিসি বাংলাকে বলছেন, “দুই একটি ছাড়া অন্য কোন কারখানার কাছে কাগজ তৈরির কাঁচামাল পাল্প নেই। ফলে কোন কারখানায় কাগজ তৈরি হচ্ছে না। যেসব প্রতিষ্ঠান বাতিল কাগজ বা বইপত্র রিসাইকল করে, তারা কিছু কিছু উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তাদের কাছেও পর্যাপ্ত কাঁচামাল নেই। ফলে কেউ বাজারে কাগজের যোগান দিতে পারছে না।”

    বাংলাদেশ পেপার ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট এবং এফবিসিসিআই পরিচালক শফিকুল ইসলাম ভুঁইয়া বিবিসি বাংলাকে বলছেন, গত দুইমাস ধরে আমরা এলসি খুলতে পারছি না। ব্যাংকের কাছে গেলেই তারা আমাদের রিফিউজ করে দিচ্ছে। মূলত ডলার সংকটের কারণেই বাজারটা অ্যাফেক্টেড হয়ে গেছে।

    ব্যবসায়ীরা জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে আগের তুলনায় কাগজের দাম কিছুটা পড়ে গেছে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ শিল্পের সুরক্ষা দিতে আমদানি করা কাগজের ওপর অনেক শুল্ক আরোপ করা রয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে এই শুল্কের হার ৬০ শতাংশের বেশি।

    শ্যামল পাল বলছেন, “বাতিল কাগজের সাথে পাল্প মিশিয়ে অনেক কারখানায় নতুন কাগজ তৈরি হয়। কিন্তু করোনার কারণে দুই বছর স্কুল-কলেজ বন্ধ ছিল। ফলে বাতিল কাগজপত্র তেমন তৈরি হয়নি। তাই মিল রিসাইকেল করার জন্য কাগজ পাচ্ছে না। এদিকে নতুন পাল্পও আমদানি করতে পারছে না। ফলে কারখানাগুলো কাগজ তৈরি করতে পারছে না।”

    সেই সঙ্গে কারখানাগুলোয় গ্যাস আর বিদ্যুতের সংকটেরও উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।

    সংকটের সমাধান করতে কী করা হচ্ছে?

    কাগজের সংকটের এই বিষয়ে নিয়ে এর মধ্যেই একাধিকবার বৈঠক করেছে এফবিসিসিআই, বাংলাদেশ ব্যাংক, শিক্ষা ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। কিন্তু ডলার সংকটের মধ্যে থাকা বাংলাদেশে এখনো এর কোন সমাধান বের হয়নি।

    প্রকাশকরা দাবি করছেন, সংকট সামলাতে তাদের যেন সাময়িকভাবে, কয়েকমাসের জন্য শুল্কমুক্ত কাগজ আমদানির সুবিধা দেয়া হয়।

    কিন্তু তাতে দেশীয় শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায় আপত্তি রয়েছে কাগজ মিল মালিকদের।

    শফিকুল ইসলাম ভুঁইয়া বলছেন, “তারা ওইভাবে কেউ দায়িত্ব নিচ্ছে না। তারা বলছে, এখন তো ডলার সংকট, খুব শীঘ্রই ভালো হবে। এই ধরনের আশ্বাস দিচ্ছে। আমাদের কেউই এলসি খুলতে পারছে না।”

    কাগজ মিল পরিচালক মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান মনে করেন, ডলার সংকট না যাওয়া পর্যন্ত এর সমাধান হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।

    তবে কিছুদিন আগে প্রকাশকদের সঙ্গে একটি আলোচনায় শিক্ষামন্ত্রী দিপু মনি বলেছে, বিশ্ব একটি কষ্টকর সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। তারপরও মুদ্রণ শিল্পের যা যা সমস্যা রয়েছে, তা সমাধানের চেষ্টা চলছে।

    এই প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কোন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। আর কথা বলাটাও কোন ফায়দা আনবে না বলেই মনে করা হয়।

    মূলত বাংলাদেশ ভূখণ্ডটি শিয়াপ্রধান পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই কথিত গণতন্ত্রপন্থী শাসকরা দেশের সম্পদ ও সাধারণ মানুষকে লুটপাটেই বেশি ব্যস্ত থেকেছে। শাসক পরিবর্তনের নামে একেকবার একেক শাসক এসে আগের দুর্নীতি ও লুটপাটে আগের শাসককে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। আর মানবরচিত শাসনব্যবস্থার অবধারিত ফলাফল এখন জনগণের সামনে স্পষ্ট; আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিক্ষাজীবনই এখন হুমকির মুখে। এদেশের সাধারণ মুসলিমদেরকে তাই কথিত ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের’ ধোঁকায় না পরে শিক্ষা-অর্থনীতি সহ সকল ক্ষেত্রে ইসলামি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মিশনে নামা উচিৎ বলেই বলে করেন ইসলামি বিশ্লেষকগণ।



    লিখেছেন :  মুহাম্মাদ ইব্রাহীম



    তথ্যসূত্র:

    ১। কাগজের সংকটে ছাপাখানা, নতুন বই আর পড়াশোনা নিয়ে আশঙ্কা-
    https://tinyurl.com/mr2hnf3b

    মন্তব্য করুন

    দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
    দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

    পূর্ববর্তী নিবন্ধশাবাবের জোরদার হামলায় মার্কিন প্রশিক্ষিত কমপক্ষে ২০ গাদ্দার হতাহত
    পরবর্তী নিবন্ধকেনিয়ান সেনা ঘাঁটিতে শাবাব কমান্ডোর দুঃসাহসি অভিযানে ৮ সেনা ধরাশায়ী