কাশ্মীরের মুসলিম যুবকরা হলো হিন্দুত্ববাদী সেনাদের অন্যতম প্রধান টার্গেট। মুসলিমদের স্বাধীনতাকামী যুদ্ধ প্রতিহত করতে এই হিন্দুত্ববাদীরা নির্বিচারে গুম ও খুন করে কাশ্মীরের মুসলিম যুবকদের। এছাড়াও শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে কাশ্মীরের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করাও তাদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।
মাসরুফ সুলতান, ১৯ বছর বয়সী এই কাশ্মীরি মুসলিম ছিলেন একজন বিজ্ঞানের ছাত্র। তিনি তাঁর পরনের শার্টটি খুলে রাখতেই দৃশ্যমান হয় হিন্দুত্ববাদী সেনাদের বর্বরতা। তাঁর শরীরের এক একটি ক্ষত, এক একটি চিহ্ন যেন কাশ্মীরের মুসলিম যুবকদের উপর হিন্দুত্ববাদী সেনাদের চালানো বর্বরতার প্রতিচ্ছবি।
মাসরুফের শরীরে ছিলো হিন্দুত্ববাদী সেনাদের ছোঁড়া দশটি বুলেটের আঘাত। সেই সাথে তাঁর শরীরে ছিলো বৈদ্যুতিক শকের ক্ষতও। ডাক্তারি রিপোর্টে অনুযায়ী, তাঁর ডান উরু, বাম উরু, উভয় হাত, ঘাড়, বুক ও মাথায় আছে গুলির আঘাত। কিন্তু এতকিছুর পরেও মাসরুফের বেঁচে যাওয়া ছিলো একদিক দিয়ে আশ্চর্যজনক এবং আরেকদিক দিয়ে সেই হিন্দুত্ববাদী সেনাদের জন্য লজ্জাজনক।
এই ঘটনার পর মাসরুফ ভীত হয়ে পড়েন। কারণ তিনি মনে করেন যে, হিন্দুত্ববাদী সেনারা হয়তো পুনরায় আসবে তাদের অসম্পূর্ণ কাজ সম্পন্ন করতে। মাসরুফের গল্প কাশ্মীরে মুসলিমদের বিরুদ্ধে হিন্দুত্ববাদী সেনাদের কৌশল সম্পর্কে অনেক কিছুরই ইঙ্গিত দেয়।
মাসরুফের ব্যাপারে হিন্দুত্ববাদী সেনাদের আনুষ্ঠানিক বিবৃতি ছিলো যে, মাসরুফ ক্রসফায়ারের শিকার হয়েছেন। কিন্তু যেকোন সুস্থ মস্তিষ্কের ব্যক্তি মাসরুফের শরীরের ক্ষত চিহ্নগুলো দেখে বলে দিতে পারবে যে, সেটি কোন ক্রসফায়ার ছিলো না। বরং সেটি ছিলো হিন্দুত্ববাদীদের অমানবিক নির্যাতন।
মাসরুফের ভাষ্য অনুযায়ী, বিএসএফের সন্ত্রাসীরা তাঁকে গাছের সাথে বেঁধে গুলি চালায়। তারা যখনই তাঁকে জীবিত দেখছিলো, তখনই তাঁর উপর গুলি চালাচ্ছিলো। তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত করতে এভাবেই তিন দফায় মোট দশটি গুলি চালায় হিন্দুত্ববাদীরা।
মাসরুফ বলেন, “আমার মৃত্যু হয়েছে কিনা তা জানতে এক অফিসার আমার মুখে হাত রাখে। আমি তখন আমার নিঃশ্বাস আটকে রাখি। তখন আমি অর্ধ সচেতন ছিলাম।”
মাসরুফের ডাক্তার বলেন যে, ইতোমধ্যেই মাসরুফের চারটি অপারেশন হয়েছে। এছাড়া আরও দুটি অপারেশন বাকী আছে। জিজ্ঞাসাবাদের সময় প্রচণ্ড লাঠিপেটার কারণে তাঁর উরু ভেঙ্গে গেছে। এছাড়াও হাঁটুতে প্রচন্ড আঘাত লাগায় তিনি এখন আর হাঁটতে পারছেন না। মোট কথা তিনি ‘সারাজীবনের জন্য পঙ্গু’ হয়ে গেছেন।
কাশ্মীরে দখলদার হিন্দুত্ববাদী সেনারা বিভিন্ন জায়গায় চেকপোস্ট বসিয়ে সেখানের মুসলিমদের হয়রানি করে থাকে। এছাড়াও যখন তখন এসব চেকপোস্টে কাশ্মীরি মুসলিমদের খুন করার ‘অধিকারও’ তারা রাখে।
ঠিক এমনই এক চেকপোস্টে মাসরুফের বাস থামিয়ে তাঁকে গাড়ি থেকে নামায় হিন্দুত্ববাদী সেনারা। এরপর ‘সন্ত্রাসী’ (অর্থাৎ স্বাধীনতাকামী) ট্যাগ দিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মাসরুফকে নিয়ে যায় তাদের টর্চার সেলে।
সাধারণত কেউ স্বাধীনতাকামী কিনা তা নিশ্চিত হতে হিন্দুত্ববাদী সেনারা ‘বিড়াল’ এর সহায়তা নেয় (অর্থাৎ গুপ্তচরের, যারা স্বাধীনতাকামীদের ব্যক্তিগতভাবে চিনে)। এসব গোয়েন্দাদের ‘বিড়াল’ নামে অভিহিত করার কারণ হলো, তাদের সারা শরীর ঢাকা থাকে এবং শুধু দুই চোখ দেখা যায়।
কাশ্মীরের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি এবং মানবাধিকার কর্মী মুফতি বাহাউদ্দিন ফারুকী বলেন যে, “এই বিড়ালদের হাতে রয়েছে জীবন ও মৃত্যুর শক্তি (আস্তাগফিরুল্লাহ্)। সে শুধুমাত্র তার আঙ্গুলের ইশারায় যাকে ইচ্ছা তাকে গ্রেপ্তার কিংবা খুন করাতে পারে। এরা সাধারণত হুমকি বা নির্যাতনের ভয়ে তথ্যদাতা হিসেবে কাজ করে। তবে এও সত্য যে, এদের মধ্যে কিছু লোক এসব কাজ করে শুধুমাত্র টাকার জন্যে।”
এই ঘটনার পর মাসরুফের জীবন চিরতরে বদলে যায়। গাড়ি থেকে নামানোর কয়েক ঘন্টা পরই তাঁকে টর্চার সেলে নিয়ে যায় হিন্দুত্ববাদীরা।
মাসরুফের ভাষায়, তাঁকে যে কক্ষে নেওয়া হয় তার উপরে বড় একটি দড়ি ঝুলানো ছিলো, একটি বড় রোলার ছিলো (যা সাধারণত কাশ্মীরি মুসলিমদের শরীরের উপর চালানো হয়) এবং একটি বৈদ্যুতিক যন্ত্র ছিলো (যা হিন্দুত্ববাদী সেনাদের কাছে কাশ্মীরি মুসলিমদের নির্যাতনে ব্যবহৃত খুবই ‘জনপ্রিয়’ একটি অস্ত্র)।
মাসরুফ বলেন, সেই যন্ত্রের তারগুলি তাঁর লিঙ্গ এবং দুই পায়ের বড় আঙ্গুলের সাথে সংযুক্ত করে দিয়ে তাঁর উপর বারবার পানি নিক্ষেপ করছিলো হিন্দুত্ববাদী সেনারা।
“আমাকে তিনবার ইলেকট্রিক শক দেয় তারা। এতে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। আমার নাক-মুখ থেকে রক্ত বের হতে থাকে। তারা লাঠি দিয়ে আমার হাঁটুতে মারতে থাকে।”- মাসরুফ বলেন।
কাশ্মীরের কোনও মুসলিম যুবকই হিন্দুত্ববাদী সেনাদের কাছে নিরাপদ নয়। কাশ্মীরি মুসলিম যুবকদের নির্বিচারে খুন, গুম এমনকি ধর্ষণ করাও কাশ্মীরিদের বিরুদ্ধে হিন্দুত্ববাদীদের যুদ্ধের একটি অংশ। তাইতো শিশু থেকে বৃদ্ধ- কাশ্মীরে বসবাসকারী সকলেরই অভিপ্রায় একটাই- ‘একটি স্বাধীন ভূখণ্ড’।
অনুবাদক ও সংকলক : আবু-উবায়দা
তথ্যসূত্রঃ
1. Indian torturers fail to break Kashmir’s will [Page- 11]
– https://tinyurl.com/y2nrp653
আগের পর্বগুলো পড়ুন
১। কাশ্মীরে দখলদার হিন্দুত্ববাদীদের অপরাধনামা ।। পর্ব-১।। চিকিৎসা সেবায় ঘাটতি
– https://alfirdaws.org/2022/09/24/59437/
২। কাশ্মীরে দখলদার হিন্দুত্ববাদীদের অপরাধনামা।। পর্ব-২।। ধর্ষণ যাদের সংস্কৃতি
– https://alfirdaws.org/2022/09/25/59476/
৩। কাশ্মীরে দখলদার হিন্দুত্ববাদীদের অপরাধনামা || পর্ব-৩ || নাসরুল্লাহপুরার হত্যাকাণ্ড
– https://alfirdaws.org/2022/09/28/59560/
৪। কাশ্মীরে দখলদার হিন্দুত্ববাদীদের অপরাধনামা।। পর্ব-৪।। সাফাকাদাল হত্যাকাণ্ড
– https://alfirdaws.org/2022/10/04/59692/
৫। কাশ্মীরে দখলদার হিন্দুত্ববাদীদের অপরাধনামা।। পর্ব-৫।। সোপোর হত্যাকাণ্ড
– https://alfirdaws.org/2022/10/12/59884/
৬। কাশ্মীরে দখলদার হিন্দুত্ববাদীদের অপরাধনামা।। পর্ব-৬।। শ্রাবালা হত্যাকাণ্ড
– https://alfirdaws.org/2022/10/21/60088/
৭। কাশ্মীরে দখলদার হিন্দুত্ববাদীদের অপরাধনামা।। পর্ব-৭।। আশিক হুসাইন মাসুদি হত্যা
– https://alfirdaws.org/2022/10/31/60308/
৮। কাশ্মীরে দখলদার হিন্দুত্ববাদীদের অপরাধনামা।। পর্ব-৮।। বিজবেহারা হত্যাকাণ্ড
– https://alfirdaws.org/2022/11/11/60647/
৯। কাশ্মীরে দখলদার হিন্দুত্ববাদীদের অপরাধনামা।। পর্ব-৯।। ডাল-গেট হত্যাকাণ্ড
– https://alfirdaws.org/2022/11/20/60813/
১০। কাশ্মীরে দখলদার হিন্দুত্ববাদীদের অপরাধনামা।। পর্ব-১০।। মুসলিমদের অঙ্গ অপসারণ
– https://alfirdaws.org/2022/12/01/61059/