“আমি অনেক আগেই আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু শুধুমাত্র আমার সন্তানদের দিকে তাকিয়ে তা করিনি। তাঁকে ছাড়া আমি কিভাবে সবকিছু দেখাশোনা করবো সেই চিন্তা কখনোই আমার পিছু ছাড়ে না। আমার চার সন্তানকে বড় করতে যতটুকু সম্ভব আমি সব করছি। মানুষের ঘরে কাজ করে কিংবা গোবর পরিষ্কার করে আমি আমার বাচ্চাদের বই-খাতা কেনার খরচ যোগাই। আমাদের দুঃখ-কষ্ট দেখার কেউ নেই। শ্রীনগর আদালতে এখনও একটি মামলা চলমান। কিন্তু সেখান থেকে এখনও কিছু বের হয়ে আসে নি। আমি ভিক্ষা করে কিছু টাকার ব্যবস্থা করেছিলাম শ্রীনগর আদালতে যাবার জন্য। কিন্তু শেষমেশ আমার সব কষ্টই ব্যর্থ হয়।”
বলছিলেন মীমা আক্তার, এক কাশ্মীরি মুসলিম নারী। মীমা আক্তার একজন ‘অর্ধ বিধবা’।
‘অর্ধ বিধবা’- কাশ্মীরে বহুল প্রচলিত একটি শব্দ। সাধারণত কাশ্মীরের সেসব মুসলিম নারীদেরকে অর্ধ বিধবা বলা হয়, যারা এখনও জানেন না যে তাঁদের স্বামীরা কোথায়। যারা এখনও জানেন না যে আদৌ তাঁদের স্বামীরা বেঁচে আছেন না মারা গেছেন। এমনই অনিশ্চয়তায় এসব কাশ্মীরি মুসলিম নারীরা কাটিয়ে দেন বছরের পর বছর।
কাশ্মীরে এমন অর্ধ বিধবা মুসলিম নারীর প্রত্যেকেরই স্বামীর কাহিনী অনেকটা একই রকম। তাঁদের স্বামীরা ঘর থেকে কাজের উদ্যেশ্যে বের হন এবং তারপর আর ফিরে আসেন না। কাশ্মীরি মুসলিমরা বলে থাকেন, যেসব বেসামরিক মুসলিম নিখোঁজ হন তাদের সাধারণত অপহরণ কিংবা খুন করে দখলদার হিন্দুত্ববাদী সেনারা। অবশ্য কোন কোন ক্ষেত্রে দখলদার সেনারা ঘরে ঢুকেই বেসামরিক মুসলিমদের টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায়। এবং এরপর তাদের আর কোন হদিস পাওয়া যায় না।
মীমা আক্তারের কাহিনীও অনেকটা একই রকম। মীমার স্বামী গুলজার আহমেদ জারগার ২০০৭ সালে ঘর থেকে নিজের কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে বের হন। এবং তারপর আর ফিরে আসেন নি। গুলজার নিখোঁজ হবার পর মীমা আক্তার এখন তাঁর চার সন্তানকে নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। শুধুমাত্র তাঁর সন্তানদের দিকে তাকিয়ে তিনি এখনও সংগ্রাম করে যাচ্ছেন।
বিবি ফাতিমা, মীমা আক্তারের মতো তিনিও জানেন না যে তাঁর স্বামী কোথায়। ১৯৯৩ সালে তাঁর স্বামী ভিলায়াত শাহ্ ঘর থেকে বের হন কাজের উদ্দেশ্যে। এরপর ভিলায়াত আর ঘরে ফেরেননি। ফাতিমা বলেন, “আমি কয়েক মাস যাবত তাঁর খোঁজ চালাই। শুধুমাত্র হিন্দুত্ববাদী বাহিনীর ক্যাম্প বাদে বাকী সব জায়গায় তাঁকে খুঁজি। অতঃপর তাঁকে কোথাও না পেয়ে আমি হাল ছেড়ে দেই।”
বেগম জান এর কাহিনীও বিবি ফাতিমার মতোই। তাঁর স্বামীও ১৯৯৮ সালের কোন একদিন মাগরিবের সালাত আদায় করতে মসজিদের উদ্দেশ্যে বের হন। এবং তারপর তিনি নিখোঁজ হয়ে যান। বেগম জান বলেন, “হিন্দুত্ববাদী বাহিনী জঙ্গলে অভিযানের জন্য জোরপূর্বক গ্রামের মুসলিম পুরুষদের ‘গাইড’ (পথ নির্দেশক) হিসেবে সঙ্গে নিয়ে যায়। এসব বেসামরিক মুসলিমদের অনেকেই পরবর্তীতে আর তাঁদের পরিবারের কাছে ফিরে আসেন না। তবে আমরা এখনও আমাদের স্বামীদের জন্য অপেক্ষা করি। কে জানে, হয়তো কোন একদিন তারা আমাদের কাছে ফিরে আসবে।”
কাশ্মীরের এই অর্ধ বিধবা নারীরা না পারে একটি নতুন জীবন শুরু করতে আর না পারে তাঁদের অতীতকে ভুলে যেতে। এই অতীতের গ্লানি নিয়েই তাঁদের কাটাতে হয় বাকীটা জীবন। আর্থিক-সামাজিক সব দিক দিয়ে এসব নারীদেরকে পোহাতে হয় চরম ভোগান্তি। আনুষ্ঠানিকভাবে স্বামীকে মৃত প্রমাণ করতে না পারায় তাঁদের অনেকেই পান না স্বামীর সম্পত্তির অংশটুকুও।
অন্যদিকে দখলদার প্রশাসন এসকল ভুক্তভোগী নারীদের সাহায্য ভাতা দেবার ক্ষেত্রেও করে নানান গড়িমসি। সাহায্য ভাতার বদলে এই অসহায় মুসলিম নারীদেরকে তারা তাদের কুপ্রস্তাবে রাজি হতে বলে। কেউ কেউ আবার এই অসহায় নারীদের কাছ থেকে চায় ঘুষও।
কাশ্মীরি মুসলিমদের অনেকেই বলেছেন, হিন্দুত্ববাদী সেনারা সাধারণত এই বেসামরিক মুসলিমদের অপহরণ কিংবা পরিকল্পিত এনকাউন্টারের মাধ্যমে খুন করে।
কাশ্মীরের মানবাধিকার কর্মী খুররাম পারভেজ, জিনি এখন জেলে বন্দী, তিনি বলেছেন, “অনেক সময় এই হিন্দুত্ববাদী সেনারা নিরীহ বেসামরিক কাশ্মীরি মুসলিমদের ‘বিদেশি বিদ্রোহী’ (অর্থাৎ স্বাধীনতাকামী) আখ্যা দিয়ে খুন করে। কারণ তাদের কেউ কোন স্বাধীনতাকামীকে খুন করতে পারলে তাকে পদোন্নতি, মেডেল কিংবা উচ্চতর পুরষ্কার প্রদান করে হিন্দুত্ববাদী সেনাবাহিনী। আর একজন হিন্দুত্ববাদী সেনা কখনওই কোন নিরীহ কাশ্মীরি মুসলিমকে খুন করার দায়ে সাজা ভোগ করে না।”
এভাবেই দখলদার হিন্দুত্ববাদী সেনারা নিরীহ কাশ্মীরি মুসলিম পুরুষদের ‘পুরষ্কারের’ লোভে গুম ও খুন করে। আর এতে করে ভুক্তভোগী হয় কাশ্মীরি মুসলিম নারীরা। কারণ এই নারীরা কখনওই জানতে পারেন না যে, তাদের স্বামীর সাথে আসলে কি হয়েছে- বেঁচে আছেন না মারা গেছেন। আর এমনই অনিশ্চয়তায় তাঁরা কাটিয়ে দেয় বাকি জীবন, কাটিয়ে দেয় অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে।
কেউ কেউ আবার তাঁদের অসহনীয় যন্ত্রণার কাহিনী শোনাতে শোনাতে বিরক্ত। যেমনটি বানু বেগম নামের এক অর্ধ বিধবা বলেছেন, “মিডিয়া শুধু আমাদের কাহিনী বিক্রিই করতে পেরেছে। কিন্তু তাদের এসব প্রতিবেদন কি আমাদের স্বামীদের ফেরত আনতে পেরেছে?”
অনুবাদক ও সংকলক : আবু-উবায়দা
তথ্যসূত্র:
1. The forgotten half-widows of Kashmir’s armed conflict
– https://tinyurl.com/56b3e88m
2. The dilemma of Kashmir’s half-widows
– https://tinyurl.com/yckj7aec
3. How a ‘Half Widow’ of Kashmir is doing menial jobs to support her Family
– https://tinyurl.com/yes9m9be
আগের পর্বগুলো পড়ুন
১। কাশ্মীরে দখলদার হিন্দুত্ববাদীদের অপরাধনামা ।। পর্ব-১।। চিকিৎসা সেবায় ঘাটতি
– https://alfirdaws.org/2022/09/24/59437/
২। কাশ্মীরে দখলদার হিন্দুত্ববাদীদের অপরাধনামা।। পর্ব-২।। ধর্ষণ যাদের সংস্কৃতি
– https://alfirdaws.org/2022/09/25/59476/
৩। কাশ্মীরে দখলদার হিন্দুত্ববাদীদের অপরাধনামা || পর্ব-৩ || নাসরুল্লাহপুরার হত্যাকাণ্ড
– https://alfirdaws.org/2022/09/28/59560/
৪। কাশ্মীরে দখলদার হিন্দুত্ববাদীদের অপরাধনামা।। পর্ব-৪।। সাফাকাদাল হত্যাকাণ্ড
– https://alfirdaws.org/2022/10/04/59692/
৫। কাশ্মীরে দখলদার হিন্দুত্ববাদীদের অপরাধনামা।। পর্ব-৫।। সোপোর হত্যাকাণ্ড
– https://alfirdaws.org/2022/10/12/59884/
৬। কাশ্মীরে দখলদার হিন্দুত্ববাদীদের অপরাধনামা।। পর্ব-৬।। শ্রাবালা হত্যাকাণ্ড
– https://alfirdaws.org/2022/10/21/60088/
৭। কাশ্মীরে দখলদার হিন্দুত্ববাদীদের অপরাধনামা।। পর্ব-৭।। আশিক হুসাইন মাসুদি হত্যা
– https://alfirdaws.org/2022/10/31/60308/
৮। কাশ্মীরে দখলদার হিন্দুত্ববাদীদের অপরাধনামা।। পর্ব-৮।। বিজবেহারা হত্যাকাণ্ড
– https://alfirdaws.org/2022/11/11/60647/
৯। কাশ্মীরে দখলদার হিন্দুত্ববাদীদের অপরাধনামা।। পর্ব-৯।। ডাল-গেট হত্যাকাণ্ড
– https://alfirdaws.org/2022/11/20/60813/
১০। কাশ্মীরে দখলদার হিন্দুত্ববাদীদের অপরাধনামা।। পর্ব-১০।। মুসলিমদের অঙ্গ অপসারণ
– https://alfirdaws.org/2022/12/01/61059/
১১। কাশ্মীরে দখলদার হিন্দুত্ববাদীদের অপরাধনামা।। পর্ব-১১।। এক মুসলিম যুবকের করুণ পরিণতি
– https://alfirdaws.org/2022/12/08/61220/