ইতিহাসের নানান সন্ধিক্ষণে আফগানিস্তানের বীর মুজাহিদদের কাছে পরাজয় বরণ করেছে বিশ্বের আগ্রাসি সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তিগুলো। মহান রবের সাহায্যে অসীম সাহসিকতা আর পাহাড়সম ধৈর্য নিয়ে তাঁরা বাতিল শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছেন যুগের পর যুগ। আফগান জাতি ও গোটা মুসলিম উম্মাহর সম্মান ও মর্যাদাকে আন্তর্জাতিক স্তরে সমুন্নত করেছেন আফগানের বীর মুজাহিদরা। অকাতরে আল্লাহর রাহে নিজেদের জান কুরবান করে তাঁরা পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে রেখে গেছেন সম্মান, মর্যাদা ও আত্মনির্ভরশীলতার অনন্য দৃষ্টান্ত।
যুগের এমনই এক সন্ধিক্ষণে উম্মাহর বীর সন্তানদের অন্যতম সিপাহসালার হিসেবে অনবদ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন ইমারতে ইসলামিয়া আফগানিস্তানের পূর্বতন আমিরুল মু’মিনিন “শহীদ” মোল্লা আখতার মোহাম্মদ মানসুর (রহিমাহুল্লাহ্)।
মোল্লা মোহাম্মদ ওমর মুজাহিদ রহিমাহুল্লাহ্’র মৃত্যুর পর তাঁকে তালিবান আন্দোলনের সর্বোচ্চ নেতা বা আমিরুল মু’মিনিন ঘোষণা করা হয়। ক্রুসেডার মার্কিন ড্রোন হামলায় তিনি ২০১৬ সালের ২১ মে তারিখে শাহাদাত বরণ করেন (ইনশাআল্লাহ)।
তাঁর জীবনের প্রথম বছরগুলো:
মোল্লা আখতার মোহাম্মদ মানসুর (রহিমাহুল্লাহ্) ১৯৬৮ সালে আফগানিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলীয় কান্দাহার প্রদেশের বেন্ড-ই তৈমুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এই অঞ্চলে ধর্মীয় শিক্ষার ক্ষেত্রে মোল্লা মানসুরের পরিবার ছিল সুপরিচিত।
মোল্লা মানসুর রহিমাহুল্লাহ্ তাঁর পিতার তত্ত্বাবধানে নিজ বসতিতেই প্রাথমিক শিক্ষা এবং স্থানীয় মাদ্রাসায় মাধ্যমিক শিক্ষা লাভ করেন। তালিবান আন্দোলনের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিদের মতো, সোভিয়েত দখলদারিত্বের কারণে তাঁর শিক্ষাজীবনও ব্যাহত হয়।
তিনি ১৯৮০’র দশকের মাঝামাঝি সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তবে যুদ্ধের বছরগুলোতে যুদ্ধের তীব্রতা সত্ত্বেও তিনি তাঁর শিক্ষা চালিয়ে যান।
১৯৮৫ সালে তিনি কান্দাহার প্রদেশের পেঞ্জভায় জেলায় ফ্রন্ট লাইনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। এরপর দেশ থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রত্যাহারের সাথে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধের সময় তিনি অস্ত্র ছেড়ে দিয়ে পুনরায় পড়াশোনায় মনযোগ দেন।
তালিবান আন্দোলনে যোগদান:
১৯৯৪ সালে যখন তালিবান প্রতিষ্ঠিত হয়, তখনই মোল্লা মানসুর তালিবান আন্দোলনের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে সামনে আসেন। সে বছর তালিবানরা যখন দেশের দক্ষিণে অগ্রসর হয়, তখন তিনি কান্দাহার বিমানবন্দরের মহাব্যবস্থাপক এবং পরবর্তীতে কান্দাহার বিমান বাহিনী ও বিমান প্রতিরক্ষা প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আর ১৯৯৬ সালে মুজাহিদগণ রাজধানী কাবুল বিজয় করার পর তিনি তালিবান সরকারের (ইমারাতে ইসলামিয়ার) বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তিনি বিমান বাহিনী ও বিমান প্রতিরক্ষা বাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন।
তাঁর মেয়াদে তিনি দেশে বিমান চলাচলের ক্ষেত্রে অনেক অবকাঠামোগত উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করেন। আফগানিস্তানে স্থল (রানওয়ে) ও আকাশে বিমান চলাচলের ক্ষেত্রে অনেক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন মোল্লা মানসুর (রহিমাহুল্লাহ্)।
২০০১ সালে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে আক্রমণ করে, মোল্লা মানসুর তখন আগ্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে মুজাহিদিন কর্তৃক পরিচালিত যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মোল্লা মানসুর তালিবান কাউন্সিলের একজন সিনিয়র সদস্য থাকাকালীন কান্দাহার প্রদেশের সামরিক প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। একই সাথে পার্শ্ববর্তী উরুজগান, জাবুল এবং হিলমান্দ প্রদেশে সম্মিলিত দখলদার বাহিনী ও তাদের তাঁবেদারদের বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অনেক অভিযানের ক্ষেত্রেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তালিবান মুজাহিদিন কর্তৃক ২০০৩ এবং ২০০৮ সালে কান্দাহার কারাগারে পরিচালিত ঐতিহাসিক অভিযানগুলোতেও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মোল্লা মানসুর।
২০০৭ সালে মোল্লা উবাইদুল্লাহ আখুন্দ গ্রেফতার হবার পর, মোল্লা মানসুরকে তালিবান আন্দোলনের ভারপ্রাপ্ত আমীর হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। এরপর ২০১০ সালে মোল্লা বারাদার আখুন্দের গ্রেফতার এবং গাদ্দার পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর কারাগারে মোল্লা উবাইদুল্লাহর মৃত্যুর পর, মোল্লা আখতার মোহাম্মদ মানসুর প্রয়াত আমীরুল মু’মিনিন মোল্লা মোহাম্মদ ওমর মুজাহিদের প্রথম সহকারী হিসাবে নিযুক্ত হন।
ঐ বছরগুলোতে আফগানিস্তানে সংঘাত চরমে পর্যায়ে পৌঁছে এবং তালিবান মুজাহিদিন বেশ কিছু ধাক্কা খান। এক কথায় তা ছিল মুজাহিদদের জন্য এক কঠিন সময়। তখন মোল্লা মানসুর এই দুঃসময়ে তালিবান আন্দোলনের হাল ধরেন।
তালিবান আন্দোলনের সর্বোচ্চ নেতৃত্বে মোল্লা মানসুর:
তালিবান আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা নেতা ও আমীরুল মু’মিনিন মোল্লা ওমর মুজাহিদ ২০১৩ সালের ২৩শে এপ্রিল মহান রবের ডাকে সাড়া দিয়ে ক্ষণস্থায়ী এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। এরপর তালিবান আন্দোলনের শুরা কাউন্সিল ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাগণ মোল্লা মানসুরের প্রতি আনুগত্যের বায়াত করেন। তবে কৌশলগত কারণে ৩০ জুলাই ২০১৫ তারিখ পর্যন্ত মোল্লা মানসুরের নেতৃত্ব সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করা থেকে বিরত থাকে তালিবান নেতৃবৃন্দ। ফলে প্রয়াত আমীরুল মু’মিনিনের মৃত্যুর প্রায় ২ বছর পর বিষয়টি প্রকাশ করেন মুজাহিদ উমারাগণ।
ইমারাতে ইসলামিয়ার দুঃসময়ে হাল ধরা কিংবদন্তি নেতার শাহাদাত:
দীর্ঘ সাত বছর পূর্বে ২১ মে তারিখে শাহাদাত বরণ করেন ইমারাতে ইসলামিয়ার দুঃসময়ের হাল ধরা কিংবদন্তি নেতা মোল্লা আখতার মোহাম্মদ মানসুর (রহিমাহুল্লাহ্)। জানা যায়, পাক-আফগান সীমান্তের বেলুচিস্তান অঞ্চলে মোল্লা মানসুরের গাড়িকে লক্ষ্য করে ড্রোন হামলা চালায় ক্রুসেডার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই হামলায় মোল্লা মানসুর শাহাদাত বরণ করেন (ইনশাআল্লাহ)।
যেমন ছিলেন এই কিংবদন্তি নেতা:
শ্বেত ভল্লুক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আরেক আগ্রাসী পরাশক্তি আমেরিকার আক্রমণ রুখে দিতে ইসলাম ও শাহাদাতপ্রিয় তরুণরা আত্মত্যাগ আর নিজেদের রক্তে সিঞ্চিত করতে থাকেন আফগানের মাটি। আর মোল্লা মানসুর তরুণদের এই প্রচেষ্টা, কর্ম ও আত্মত্যাগকে বৃথা যেতে দেননি। তিনি মুজাহিদদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাড়ি জমাতেন এক ময়দান থেকে অন্য ময়দানে। তিনি কখনো নিজেকে তরুণ মুজাহিদদের থেকে উচ্চতর মনে করতেন না! নেতৃত্বের কঠিন সময়েও যৌবনের পবিত্র চেতনাকে স্তিমিত হতে দেননি তিনি, যা জিহাদি অঙ্গনে তাঁর সংগ্রাম ও ত্যাগের সাক্ষী বহন করে চলেছে।
কূটনৈতিক ময়দানেও বিশ্বকে অবাক করে দিয়েছিল তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব। জিহাদের ময়দানগুলোতে নতুন উদ্যম ফিরিয়ে এনেছিলেন তিনি। মুজাহিদদের উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য তিনি দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্প তৈরি করেন। পাশাপাশি তিনি দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে এগিয়ে নিয়ে যান সমানতালে। তাঁর নেতৃত্বেই মুজাহিদগণ আন্তর্জাতিক সেক্যুলার ও কুফ্ফার গোষ্ঠীর মিথ্যা প্রচার মাধ্যমগুলোকে চ্যালেঞ্জ জানাতে থাকেন ক্রমাগত। বিশ্বমঞ্চে তিনি ইমারাতে ইসলামিয়ার কূটনীতিকে এমন এক অবস্থানে নিয়ে যান, যার ফলে সামরিক অঙ্গনের পাশাপাশি রাজনৈতিক অঙ্গনেও সম্মিলিত কুফ্ফার জোটের পরাজয়ের ক্ষেত্র তৈরি হতে থাকে।
শহীদ মোল্লা আখতার মোহাম্মদ মানসুর রহিমাহুল্লাহ্ তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ইসলামী শাসন ব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা জারি রেখেছিলেন। আধুনিক জিহাদের অন্যতম পথিকৃৎ এই মহান নেতার ত্যাগ, কুরবানি ও আদর্শকে বাস্তবায়নের মাঝে উম্মাহর তরুণ-যুবকেরা খুঁজে নিতে পারেন আগামীর বিজয়ের প্রাণশক্তি।