ক্ষমতার ১ম বছর: আফগানিস্তানের ভঙ্গুর অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার এক বিশুদ্ধ সংগ্রাম

7
1704

২০২১ সালের ১৫ই আগস্ট; কাবুলের বিশৃঙ্খল কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে দ্রুত পতনে অবাক হয় সবাই। আশরাফ গনি ভয় পেয়েছিল; ভেবেছিল, তার পরিণতিও সাবেক কমিউনিস্ট প্রেসিডেন্ট ড. নাজিবের মতো হবে। শেষবার যখন কাবুল তালেবানের নিয়ন্ত্রণে আসে, তখন ড. নাজিবকে ল্যাম্পপোস্টে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এমন পরিণতির আশংকায় কাবুল পতনের আগেই কিছু ঘনিষ্ঠ লোককে সাথে নিয়ে পালিয়ে যায় আশরাফ গনি। এমন অনিশ্চিত অবস্থা কাবুলকে ঠেলে দেয় বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির দিকে।

আফগানিস্তানের রাষ্ট্র যন্ত্রের পুরো কাঠামোর মতো, এর অর্থনীতিও আন্তর্জাতিক সাহায্যের উপর খুব বেশি নির্ভরশীল ছিল। আর তাই বিদেশি সৈন্য প্রত্যাহারের পর অত্যাবশ্যকভাবেই এই সবকিছু ধসে পড়ে।

দখলদারিত্বের দুই দশক জুড়ে আফগানিস্তানে শত শত বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করা হয়েছে। কিন্তু একটি স্থিতিশীল ও টেকসই অর্থনৈতিক ভিত্তি তৈরি করার বদলে, এগুলো কাজ করেছে কেবল সাময়িক চেতনা নাশক হিসেবে। এসব অর্থ আফগানিস্তানের কয়েক দশকের পুরোনো অর্থনৈতিক ক্ষত স্থায়ীভাবে নিরাময় করতে পারেনি। বরং অর্থনীতির অতল গহ্বরগুলোর উপর চাকচিক্যময় প্রলেপ দিয়েছে, অথচ ভেতরে রয়ে গেছে ফাঁপা গহ্বর।

সাহায্য-সহায়তাগুলো কেবল অকার্যকরই ছিল না, ছিল প্রতারণাপূর্ণও। অনুগ্রহ প্রদর্শনের নামে করা হয়েছিল প্রতারণা। এসব সাহায্যের বেশিরভাগ শেষ হয়ে যেত ঠিকাদার এবং এনজিওদের মাধ্যমে বৈদেশিক মূলধনে ফিরে গিয়ে। এসব ঠিকাদার ও এনজিওগুলো আফগান-যুদ্ধের মাধ্যমেই টিকে ছিল এবং এ যুদ্ধ থেকে নিজেদের লাভ খুঁজে নিতো। তাছাড়া, এই সাহায্যগুলো শেষ হতো যুক্তরাষ্ট্রের ভাড়াটে হিসেবে কাজ করা আফগানদের বিনিয়োগের মাধ্যমেও। এই আফগানরা নিজ দেশকে দখলদারদের হাতে তুলে দিয়ে নিজেদের ভাগ্য গড়েছিল।

মোটামুটি ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাৎসরিকভাবে সাহায্য পেত পূর্ববর্তী সরকার। তখন এটি ছিল আফগানিস্তানের অর্থনীতির জন্য লাইফ সাপোর্ট। গনির দেশ ত্যাগ এবং তার সরকারের পতনের পর, এই সাহায্য বন্ধ হয়ে যায়।

এভাবে নতুন আফগান সরকার তীব্র বাজেট সংকটের সম্মুখীন হয়েছিল। এতটুকুতেই শেষ নয়, আফগান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৯ বিলিয়ন ডলারও আটকে রাখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পরে প্রেসিডেন্ট বাইডেন একতরফাভাবে এই অর্থ ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেয়। সে বলে, এর অর্ধেক বরাদ্দ করা হবে আফগানিস্তানকে ‘সাহায্য’ করার জন্য। আর বাকি অর্ধেক যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে ৯/১১ হামলার ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর শুরু করা চলমান মামলা নিষ্পত্তি করতে ব্যয় করা হবে। অথচ ঐ হামলায় কোনো আফগান জড়িত ছিলেন না।

এই সম্পদ নির্বিশেষে নগদ অর্থ হিসেবে ব্যয় করার কথা ছিল না। বরং কথা ছিল, ব্যাংকিং খাতে তারল্য ও আস্থা যোগানে ব্যবহার করা হবে।

এর ফলে, ব্যাংকিং এবং তারল্য সংকটের সম্মুখীন হয় আফগানিস্তান। সবশেষে নিষেধাজ্ঞাও দেওয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশটি আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এভাবেই বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল আরও ভয়ানক অবস্থায়, খাদের কিনারে।

নির্মম উপহাস; গত কয়েক দশক ধরে আফগান জনগণের সাথে অবিরাম বন্ধুত্বের ঘোষণা দিয়েছিল কিছু দেশ। আজ সেই দেশগুলোই আফগানিস্তানকে কার্যকরভাবে গরিব বানাচ্ছে এবং সম্মিলিতভাবে শাস্তি দিচ্ছে। যেন তাদের দুই দশকের দখলদারিত্ব যথেষ্ট নয়।

চার দশক ধরে যুদ্ধ বিধ্বস্ত আফগানিস্তানের অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত করা এমনিতেই একটি কঠিন কাজ, তার উপর দেওয়া হয়েছে নিষেধাজ্ঞা। এসকল বাধা সত্ত্বেও আফগান উপ-প্রধানমন্ত্রী মোল্লা আব্দুল গনি বারাদারকে অর্থনৈতিক বিষয়াবলি দেখার দায়িত্বে নিযুক্ত করা হয়; আর অবিলম্বে কিছু মৌলিক প্রকল্প এবং পরিকল্পনাকে ঘিরে অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে বলা হয়। এসব প্রকল্পের মধ্যে প্রধানতম হচ্ছে কুশতিপা খাল মেগা প্রকল্প।

কুশতিপা খাল প্রকল্প

আফগানিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘতম খাল হলো কুশতিপা খাল। দেশটির উত্তরে বালখ প্রদেশের কালদার জেলায় অবস্থিত আমু (বা অক্সাস) নদীই হলো এই খালের উৎস। এরপর তা জাওযান প্রদেশের হাইরাতান এবং আকছা জেলার অনুর্বর মরুভূমির মধ্য দিয়ে এসে শেষ হয়েছে ফারইয়াব প্রদেশের আন্দখয় জেলায়। এটির দৈর্ঘ্য ২৮৫ কি.মি., প্রস্থ ১৫০ মিটার, এবং গভীরতা ৮ মিটার।

খালটির খনন কাজ শেষ হওয়ার পর এর মাধ্যমে ৫৫০ হাজার হেক্টর কৃষি জমিতে সেচ দেওয়া যাবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। এই খালের উদ্দেশ্য একদিকে যেমন আফগানিস্তানকে শস্য উৎপাদনে স্বাবলম্বী করা, অন্যদিকে শস্যের নিট রপ্তানিকারক হওয়ার ক্ষমতা প্রদান করা।

কামাল খান বাঁধ তৈরি করতে পূর্ববর্তী সরকার প্রতি ঘন মিটারে খরচ করেছে ১২ মার্কিন ডলার।

এই হিসাবে কুশতিপা খাল প্রকল্প সম্পন্ন করতে খরচ হওয়ার কথা ছিল ৫.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জাতীয় উন্নয়ন কর্পোরেশন দুর্নীতি ও অন্যান্য অপব্যবহার শনাক্ত করার মাধ্যমে এর খরচ অনেক কমিয়েছে। প্রতি ঘন মিটারে ১২ মার্কিন ডলার থেকে কমিয়ে কেবল ৭৫ আফগানি মুদ্রায় নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। অর্থাৎ, কুশতিপা খাল প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রতি ঘন মিটারে ১ মার্কিন ডলারের চেয়েও কম খরচ হচ্ছে।

কুশতিপার ক্ষেত্রে এভাবে আনুমানিক খরচ ধরা হয়েছে ৩৩.৭৫ বিলিয়ন আফগানি, মোটামুটি যা ৩৮৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমান। স্থানীয় ১২০টি নির্মাণ কোম্পানি থেকে প্রায় ১৪০০ যন্ত্রপাতি কাজে লাগানো হয়েছে এবং স্থানীয়দের জন্য হাজার হাজার কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমান অনুমান অনুযায়ী প্রকল্পটি শেষ হওয়ার মাধ্যমে যন্ত্রপাতির ব্যবহার তিনগুণ হবে।

পূর্ববর্তী ছদ্মবেশী মিত্ররা বহু বাধা তৈরি করে রেখেছিল। তা সত্ত্বেও এই প্রকল্পটি আফগানদের নিজস্ব পরিকল্পনায়, নিজস্ব অর্থায়নে, নিজেদের দ্বারা বাস্তবায়িত হচ্ছে।

কাশকারি তেল কূপ

image

আফগানিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলের প্রদেশ সার-এ-পোলে অবস্থিত কাশকারি তেল কূপ। গত ৭ই এপ্রিল অফিসিয়ালভাবে এটি উদ্বোধন করা হয়। আর এখান থেকে এখন দৈনিক ২০০ টন অপরিশোধিত তেল উত্তোলন করা হচ্ছে। বর্তমানে চীনা কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আলোচনা চলছে। এই মর্মে একটি চুক্তি হওয়ার কথা চলছে যে, তারা দৈনিক সম্ভাব্য ১৫০০-২০০০ টন তেল উত্তোলন করবে।

খনি

আফগানিস্তান খনি ও মূল্যবান পাথরের ভাণ্ডারে সমৃদ্ধ। দেশটির বিরল ভৌগলিক উপাদানগুলো আধুনিক অর্থনীতি, প্রযুক্তি এবং সামরিক বাহিনীর জন্য অপরিহার্য।

এর মধ্যে একটি হলো লিথিয়াম। রিচার্জেবল ব্যাটারি এবং বিশুদ্ধ প্রযুক্তির জন্য এটি একটি প্রয়োজনীয় উপাদান। আর এই উপাদানটি আফগানিস্তানে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায় বলে তথ্য আছে।

অবশ্য অন্যান্য উপাদানের পাশাপাশি সরকারের মনোযোগ প্রধানত কয়লা উত্তোলনে। খনি ও পেট্রোলিয়াম মন্ত্রণালয়ের রিপোর্ট অনুযায়ী, সারা দেশে দৈনিক ষোল হাজার টন কয়লা উত্তোলন করা হয়।

কয়লা নিষ্কাশনের উপর ধার্য করা রয়্যালটি এবং রপ্তানিকারক ট্রাকগুলোর উপর আরোপিত শুল্ক রাষ্ট্রীয় কোষাগারে বড় অবদান রাখছে। বর্তমানে বৈশ্বিক জ্বালানি সংকট প্রকট। এ কারণে ব্যাপক এবং ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে, রাজস্বের একটি উল্লেখযোগ্য উৎস হয়ে উঠতে পারে এই কয়লা।

সরকার বর্তমানে প্রতিবেশী দেশগুলোর বাজারের বাইরেও রপ্তানি বাড়ানো এবং বৈচিত্র্য আনার উপায় অন্বেষণে কাজ করছে৷

সীমান্ত বাণিজ্য

আফগানিস্তানের সাতটি বেশ ব্যস্ত সীমান্ত ক্রসিং রয়েছে। ফলে এগুলোর মাধ্যমে ব্যবসা বৃদ্ধি করে আফগানিস্তান লাভবান হচ্ছে। আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্যের মাধ্যমে আয়ের পরিপ্রেক্ষিতে, নতুন সরকার রাজস্ব সংগ্রহকে নিয়মিত ও কেন্দ্রীভূত করার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে। পূর্বে সারাদেশে বিভিন্ন চেকপয়েন্ট স্থাপন করে অবৈধ অর্থ দাবি করতো প্রভাবশালীরা। এটিও দূর করেছে সরকার।

রাজস্ব কার্যকরভাবে পরিচালনা এবং স্বচ্ছভাবে সংগ্রহের জন্য সরকার বিসিপি-তে কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছে। আর শুল্ক ডেটার জন্য অটোমেটেড সিস্টেম নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রয়োগ করেছে। পূর্ববর্তী সরকার এগুলো করতে পারেনি।

এই পদ্ধতিতে কর রাজস্ব সরাসরি অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রেরণ করা হয়। আর ঘুষ খেতে অভ্যস্ত কর্মচারীরাও এখন অবৈধ অর্থ গ্রহণ করতে পারছে না।

এই পদক্ষেপগুলো সরকারকে ২৩২ বিলিয়ন আফগানী (প্রায় ২.৫ বিলিয়ন ডলার) বাজেট ঘোষণা করতে সক্ষম করেছে। এই বাজেট কয়েক দশকের মধ্যে, সম্ভবত এক শতাব্দীরও বেশি সময়ের মধ্যে প্রথমবারের মতো সম্পূর্ণ দেশীয় রাজস্বে অর্থায়ন করা হয়েছে।

যুদ্ধবিধ্বস্ত ও দুর্নীতিগ্রস্ত দেশে আমদানির মান নিয়ন্ত্রণ যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি চ্যালেঞ্জিংও ছিল। পূর্ববর্তী শাসনামলে মাফিয়াদের দ্বারা ব্যাপকভাবে নিয়ন্ত্রিত জ্বালানির গুণগতমান নিয়ন্ত্রণ করা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আফগানিস্তান ন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড অথরিটি (এএনএসএ) গুণগতমান যাচাইয়ের কঠোর নিয়ম প্রয়োগ করেছে এবং স্ট্যান্ডার্ডের নীচে যেগুলো পেয়েছে, ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে।

মাটিতে তেলের ঘাটতি হলে সরকারকে নিম্নমানের জ্বালানি আমদানির অনুমতি দিতে বাধ্য করার জন্য, জ্বালানি আমদানিকারকরা প্রতিবেশী দেশগুলোর সীমান্ত ক্রসিংয়ের কাছে শত শত তেলের ট্যাঙ্কার আটকে রাখে। যার ফলে দেশে জ্বালানির তীব্র সংকট দেখা দেয়, আর দাম হয় আকাশচুম্বী।

এ ধরনের যেকোনো সংকট রোধ করতে এবং ভবিষ্যতে বাজারের আস্থা বজায় রাখার জন্য, সরকার তার তেল ও গ্যাস কর্পোরেশনের মাধ্যমে নিজস্বভাবে কেনাকাটা করে। এটি বাজারে গভীর ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

ইমারাতে ইসলামিয়ার অফিসিয়াল সাইট থেকে অনুবাদকৃত।

অনুবাদ করেছেন: সাইফুল ইসলাম

7 মন্তব্যসমূহ

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধশাবাবের কৌশলী “সমর-ফাঁদ”: ভয় আর উৎকন্ঠায় তটস্থ সোমালি বাহিনী
পরবর্তী নিবন্ধহিন্দুত্ববাদী হাইকোর্ট থেকেও ইসলামিক স্কলারের জামিন প্রত্যাখ্যান