স্মৃতিতে উসমান বাতুর : যে বীর একাধারে লড়েছেন দখলদার রাশিয়া ও চীনের বিরুদ্ধে

5
1811
স্মৃতিতে উসমান বাতুর : যে বীর একাধারে লড়েছেন রাশিয়া ও চীনের বিরুদ্ধে

পূর্ব তুর্কিস্তান; নামটি শুনলেই চোখে ভেসে উঠে অসহায় নিপিরিত উইঘুর ও কাজাখ মুসলিমদের কথা। আরও ভেসে উঠে তাদের উপর দখলদার চীনাদের বর্বর নির্যাতনের রোমহর্ষক বর্ণনার কথা। কিন্তু এই পূর্ব তুর্কিস্তান একদিন স্বাধীন ছিল। আর তাদের ছিল একজন উসমান বাতুর।

দুই দখলদার পরাশক্তি রাশিয়া ও চীনের বিরুদ্ধে সমান্তালে যুদ্ধ করে উসমান বাতুর ছিনিয়ে এনেছিলেন পূর্ব-তুর্কিস্তানের স্বাধীনতা। ১৯৫১ সালের ২৮ এপ্রিল, ঔপনিবেশিক রাশিয়া ও পূর্ব তূর্কিস্তানে স্বৈরাচারী কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে দুর্ভেদ্য প্রতিরোধ গড়ে তোলা কাজাক মুসলিম বীর উসমান বাতুরকে চীনা প্রশাসন গ্রেফতার করে। আর ১৯৫১ সালের আজকের এই দিনেই তাকে গুলি করে হত্যা করে দখলদার চাইনিজরা; শাহাদাতের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে তিনি চলে যান তাঁর মহান রবের সান্নিধ্যে।

মুসলিম এই ঈগলের প্রকৃত নাম উসমান ইসলামগ্লু। অদম্য সাহসিতার দরুন মানুষ তাকে “উসমান বাতুর” বলেই ডাকতে বেশি ভালোবাসত! “বাতুর” শব্দের অর্থ “সাহসী / বীর”

কাজাকের আলতাই অঞ্চলের কোকতোগায়-এর অন্তর্গত ওংদিরকারায় এক মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারে ১৮৯৯ সালে উসমান বাতুর জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন কাজাখ আইতুভগান গোত্রের। তার পিতা ছিলেন ইসলাম বে। তার শৈশব কেটেছে দ্বীনি পড়ালেখা করে। যুবক বয়সে তিনি বোকে বাতুর নামের এক উস্তাদের কাছ থেকে গেরিলা যুদ্ধকৌশল আয়ত্ত করেন। পাশাপাশি তিনি ঘোড়সওয়ারি এবং মার্শাল আর্টেও নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন। তিনি ছিলেন দক্ষ ঘোড়সওয়ার, অভিজ্ঞ শিকারি এবং সম্মুখ ও গেরিলা যুদ্ধে অভিজ্ঞ এক টগবগে তরুণ।

মুসলিম জাতিগোষ্ঠীর উপর ঔপনিবেশিক রাশিয়া আর চীনের আগ্রাসন ছোটবেলা থেকেই উসমানের হৃদয়ে গভীরভাবে দাগ কাটে। তিনি বেশ কয়েকবার চীনা সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ছোটো-বড় আন্দোলনে অংশ নেন। মধ্য এশিয়ার বিস্তৃর্ণ আলতাই পর্বতমালা ও পূর্ব তূর্কিস্তানের মজলুম মুসলিমদের অধিকার আদায়ের লক্ষে ১৯১১ সালে শ্বেত ভল্লুক রাশিয়া আর চাইনিজদের বিরুদ্ধে তিনি পর্বতসম প্রতিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলেন। তার ৩ ছেলে শারদিমান, নিয়ামতউল্লাহ ও নবী তার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ১৯৪১ সালে রুশ ভল্লুকদের বিরুদ্ধে জিহাদে অংশ নেন। আলতাই পর্বতমালায় খনিজ সম্পদ লুট করতে আসা রুশদের উপর ১৯৪১ সালের ১০ মে ওসমান বাতুর তাঁর সাথীদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। অনেক রাশিয়ান সন্ত্রাসীকে সেদিন গুলি করে হত্যা করা হয়।

একদিকে চীনারা, অপরদিকে রাশিয়ানরা অনেক সামরিক চাপ প্রয়োগ করা স্বত্বেও উসমানদের আন্দোলনকে দমন করতে পারেনি। ১৯৪২ সালের মার্চ থেকে ১৯৪৩ এর এপ্রিলের মধ্যে উসমানের নেতৃত্বে চীনের বিরুদ্ধে অনেকগুলো অভিযান চালানো হয়, যার ফলে চীন ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। উসমানের সাথে না পেরে উঠে চীন উসমানের দ্বিতীয় স্ত্রী, ৩ পুত্র ও ৫ কন্যাকে কারাগারে নিক্ষেপ করে। এরপর তার একমাত্র ভাই দেলিলহান ইসলামোগ্লু কে ১৯৪২ সালে শহীদ করে দেয়।

১৯৪৩ সালের ২২ই জুলাই বুলগুনের একটি অনুষ্ঠানে উসমান বাতুরকে আলতাই কাজাকের মজলুম জনগণের শাসক হিসাবে ঘোষণা করা হয়। তারপর আর তাকে পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। মুসলিম ভূমি উদ্ধারের অদম্য স্পৃহা তাকে প্রচন্ড আন্দোলিত করতে থাকে। মজলুমদের অধিকার ফিরিয়ে আনার বাসনায় ছুটে চলা দিগ্বিজয়ী উসমান ১৯৪৫ সালে হাতে গোনা কয়েকটি শহর ব্যতীত সমগ্র পূর্ব তূর্কিস্তানকে চাইনিজ দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত করেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে দখলদার চাইনিজরা দিশেহারা হয়ে পড়ে। উসমান বাতুরের বিজয়াভিযান রুখতে তারা উক্ত অঞ্চলে সদলবলে অভিযান চালায়।

আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র আর অধিক সংখ্যক সৈন্য নিয়ে আক্রমণের ফলে অবশেষে ১৯৫১ সালে চাইনিজরা কানাম্বালে উসমান বাতুরকে অবরুদ্ধ করতে সক্ষম হয়। তারা তাকে গ্রেফতার করে পূর্ব তূর্কিস্তানের উরুমকিতে নিয়ে আসে। পরদিন অর্থাৎ ২৯ শে এপ্রিল ১৯৫১ সালে দখলদার চীনা প্রশাসন উসমান বাতুরকে জনসম্মুখে গুলি করে শহীদ করে দেয়।

আর এর মাধ্যমেই একটি জাতির বহু কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়ে আসে।

গ্রেফতারের পূর্ব মুহূর্তে সাহসী বীর উসমান বাতুরের মুখসৃত শেষ উক্তিটি নির্যাতিত মুসলিম উম্মাহকে আজো প্রেরণা যোগায়ঃ-
“আমি মৃত্যুবরণ করতে পারি, কিন্তু জেনে রাখো! কিয়ামত অবধি আমার জাতি জিহাদ চালিয়ে যাবে।”

উল্লেখ্য, পূর্ব তুর্কিস্থানের মুসলিমদের উপর কমিউনিস্ট চায়নার অত্যাচার নির্যাতন এখন তীব্রতর হয়েছে। ইসলামের উপর ক্র্যাকডাউন চালাচ্ছে চীন সরকার। পূর্ব তুর্কিস্তানের জনসংখ্যা আড়াই কোটির মতো। এরমধ্যে প্রায় ৩০ থেকে ৫০ লাখ মুসলিমকে চীন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে আটকে রেখেছে। গণধর্ষণ, শুকূরের মাংস খেতে বাধ্য করা, মেডিকেল এক্সপেরিমেন্ট, অত্যাচার- নির্যাতন, আল্লাহকে গালি দিতে বাধ্য করা, জোরপূর্বক কমিউনিস্ট সবক দিয়ে ব্রেইনওয়াশ ইত্যাদি ক্যাম্পে বন্দী মুসলিমদের নিত্য সঙ্গী। শিশুদেরকে তাদের বাবা মায়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখে নাস্তিক হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। রোযা রাখা, পর্দা করা, দাড়ি রাখা, কুরআনের কপি রাখা এমনকি সালাম দেবার মতো নিরীহ আমলও নিষিদ্ধ করেছে চীন সরকার; এসব করলে জায়গা হচ্ছে ঐ ক্যাম্পে।লুকিয়ে রোজা রাখতে এমনকি তারা বাধ্য হচ্ছেন বাথরুমে লুকিয়ে সাহরি খেতে!

বর্বর চীনারা অসংখ্য মসজিদ ধ্বংস করছে, উইঘুরদের শরীর থেকে অঙ্গ কেটে নিয়ে বিক্রি করছে, উইঘুরদের জোরপূর্বক শ্রম দিতে বাধ্য করছে। উইঘুরদের বাড়িগুলোতে প্রায় ১০ লক্ষ এজেন্ট পাঠিয়েছে চীন সরকার। এরা উইঘুরদের সাথে আত্মীয় পরিচয়ে থাকে। রাতে উইঘুর নারীদেরকে বাধ্য করে এক বিছানায় থাকতে। গোটা তুর্কিস্তান জুড়ে তারা প্রায় ২ কোটি স্মার্ট সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছে, যা দিয়ে উইঘুর ও কাজাখ মুসলিমদের প্রতিটি চাল-চলন এমনকি প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি নজরদারি করছে। কোন এক মুসলিমের কোন একটি পদক্ষেপ বা কোন মুখভঙ্গি তাদের কাছে সামান্য অস্বাভাবিক মনে হলেই নিকটস্থ ডিউটি পুলিশের কাছে বার্তা চলে যাচ্ছে, আর পুলিশ এসে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে নিয়ে যাচ্ছে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে।

চীন সরকার অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে উইঘুর মুসলিমদের নাম নিশানা মুছে দিতে চাইছে। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় সৌদি আরব, পাকিস্তানসহ অন্যান্য মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ একাজে চীনকে সহায়তা করছে। অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোও নীরবতা বজায় রেখেছে। তারা এমনকি আশ্রয় নেওয়া উইঘুর মুসলিমদের এখন চীনের হাতে তুলে দিতে শুরু করেছে। সৌদি আরব সম্প্রতি উম্রাহ করতে আসা ৭-৮ জন উইঘুর মুসলিমকে আটক করে চীনের কাছে হস্তান্তর করতে যাচ্ছে।

পূর্ব তুর্কিস্থানের অসহায় মুসলিমরা উসমান বাতুরের মতো একজন বীরের পথ চেয়ে রয়েছে। উসমান বাতুরের আজ বড় বেশী প্রয়োজন।


লিখেছেন :   ত্বহা আলী আদনান

5 মন্তব্যসমূহ

  1. ওরা আসবে রক্তের সমুদ্র সাঁতরে, ধ্বংসপাহাড় পাড়ি দিয়ে, দ্রহের আগুনে পরিশুদ্ধ হয়ে, মাটিকে প্রবল ভাবে প্রকম্পিত করে…ওরা আসবে।

  2. পূর্ব তুর্কিস্তানের মুসলমানদের উপর বর্বর কম্যিউনিস্ট হান চাইনিজ দের জুলুমের সামান্যতম বর্ণনা এই বই এ উঠে এসেছেঃ
    https://archive.org/download/shongrohoshala/%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B6%E0%A6%97%E0%A7%9C%20%E0%A6%95%E0%A6%A4%E0%A7%8B%20%E0%A6%A8%E0%A6%BE%20%E0%A6%85%E0%A6%B6%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A7%81%E0%A6%9C%E0%A6%B2.pdf

  3. দুনিয়ার কাফেররা শুনে রাখ। আমার রব তদের ব্যাপারে কি বলেন..

    তোমরা আঘাত কর তাদের ঘাড়ের উপরে এবং আঘাত কর তাদের প্র্যত্যেক জোড়ায় জোড়ায়।

    -Surah Al-Anfal, Ayah 12।

    তদের সাথে এটাই আমরা করবো আল্লাহর সাহায্যে। ইনশআল্লাহ

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধইয়েমেন | আল-কায়েদা কর্তৃক হুথিদের পুরো একটি কনভয় ধ্বংস, হতাহত অসংখ্য
পরবর্তী নিবন্ধমালিতে আল-কায়েদার হাতে আটক রাশিয়ান ভাড়াটে সৈন্য