যুগ যুগ ধরে আফগানের বীর মুজাহিরা কাফেরদের দখলদারত্বের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে গেছেন। মহান রবের সাহায্যে অসীম সাহসিকতা আর পাহাড়সম ধৈর্য নিয়ে লড়াই করে গেছেন তাঁরা যুগের পর যুগ। তাঁরা এই উম্মাহর পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সম্মান, সাহস ও স্বাধীনতার পাঠ শিখিয়ে গেছেন। আফগান ও মুসলিম উম্মাহর সম্মান ও মর্যাদাকে আন্তর্জাতিক স্তরে সমুন্নত করেছেন। এজন্য অকাতরে আল্লাহর রাহে নিজেদের জান কুরবান করেছেন অসংখ্য মুজাহিদ। এমনই একজন বীর মুজাহিদ ছিলেন পূর্ববর্তী আমিরুল মু’মিনিন “শহীদ” মোল্লা আখতার মোহাম্মদ মনসুর (রহিমাহুল্লাহ্)।
মোল্লা মোহাম্মদ ওমর মুজাহিদ রহিমাহুল্লাহ্’এর মৃত্যুর পরে উনাকে তালিবান আন্দোলনের সর্বোচ্চ নেতা বা আমিরুল মুমিনিন ঘোষণা করা হয়। ক্রুসেডার মার্কিন ড্রোন হামলায় তিনি ২২ মে, ২০১৬ -এ শাহাদাত বরণ করেন (ইনশাআল্লাহ)।
তাঁর জীবনের প্রথম বছরগুলো:
মোল্লা মোহাম্মদ মানসুর রহিমাহুল্লাহ্ ১৯৬৮ সালে আফগানিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলিয় কান্দাহার প্রদেশের বেন্ড-ই তৈমুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এই অঞ্চলে ধর্মীয় শিক্ষার ক্ষেত্রে মোল্লা মানসুরের পরিবার সুপরিচিত।
মোল্লা মানসুর রহিমাহুল্লাহ্ তাঁর পিতার তত্ত্বাবধানে নিজ বসতিতেই প্রাথমিক শিক্ষা এবং আশেপাশের মাদ্রাসায় মাধ্যমিক শিক্ষা লাভ করেন। তালিবান আন্দোলনের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিদের মতো, সোভিয়েত দখলদারিত্বের কারণে তাঁর শিক্ষা ব্যাহত হয়।
তিনি ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধের বছরগুলোতে যুদ্ধের তীব্রতা সত্ত্বেও তিনি তাঁর শিক্ষা চালিয়ে যান।
১৯৮৫ সালে তিনি কান্দাহার প্রদেশের পেঞ্জভায় জেলায় ফ্রন্ট লাইনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। এরপর দেশ থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রত্যাহারের সাথে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধের সময় তিনি অস্ত্র ছেড়ে দিয়ে পুনরায় মাদ্রাসায় পড়াশোনায় মনযোগ দেন।
মোল্লা মানসুরের তালিবান আন্দোলনে যোগদান:
১৯৯৪ সালে যখন তালিবান প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন মোল্লা মানসুর তালিবান আন্দোলনের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে সামনে আসেন। তালিবানরা যখন দেশের দক্ষিণে অগ্রসর হয়, তখন তিনি ১৯৯৪ সালে কান্দাহার বিমানবন্দরের মহাব্যবস্থাপক, পরবর্তীতে কান্দাহার বিমান বাহিনী এবং বিমান প্রতিরক্ষা প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আর ১৯৯৬ সালে মুজাহিদগণ রাজধানী কাবুল বিজয়ের পর তিনি তালিবান সরকারের (ইমারাতে ইসলামিয়ার) বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তিনি বিমান বাহিনী ও বিমান প্রতিরক্ষা বাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন।
তাঁর মেয়াদে তিনি দেশে বিমান চলাচলের ক্ষেত্রে অনেক অবকাঠামোগত কার্যক্রম পরিচালনা করেন। আফগানিস্তানে স্থল (রানওয়ে) ও আকাশে বিমান চলাচলের ক্ষেত্রে অনেক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
২০০১ সালের পর, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে আক্রমণ শুরু করে, তখন মোল্লা মানসুর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মুজাহিদিন কর্তৃক পরিচালিত যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মোল্লা মানসুর তালিবান কাউন্সিলের একজন সিনিয়র সদস্য থাকাকালীন কান্দাহার প্রদেশের সামরিক প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। একই সাথে পার্শ্ববর্তী উরুজগান, জাবুল এবং হিলমান্দ প্রদেশে দখলদার ও তাদের গোলামদের বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অনেক হামলার ক্ষেত্রেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কান্দাহারে তালিবান মুজাহিদিন কর্তৃক ২০০৩ এবং ২০০৮ সালে কারাগারে ঐতিহাসিক অভিযানগুলোও মোল্লা মানসুরের নেতৃত্বে চালানো হয়।
২০০৭ সালে মোল্লা উবাইদুল্লাহ আখুন্দকে গ্রেফতার করার পর, তাকে তালিবান আন্দোলনের ভারপ্রাপ্ত আমীর হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। এরপর ২০১০ সালে মোল্লা বারাদার আখুন্দের গ্রেফতার এবং গাদ্দার পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর কারাগারে মোল্লা উবাইদুল্লাহর মৃত্যুর পর, মোল্লা আখতার মুহাম্মদ মানসুর প্রায়াত আমীরুল মুমিনিন মোল্লা মুহাম্মদ ওমর মুজাহিদের প্রথম সহকারী হিসাবে নিযুক্ত হন।
এই বছরগুলোতে যখন আফগানিস্তানে সংঘাত চরমে পর্যায়ে পৌঁছে এবং তালিবান মুজাহিদিন বেশ কিছু ধাক্কা খান, এককথায় যেটা ছিল মুজাহিদদের জন্য একটি কঠিন সময়, তখন মোল্লা মানসুর এই দুঃসময়ের হাল ধরেন।
তালিবান আন্দোলনের সর্বোচ্চ নেতৃত্বে মোল্লা মানসুর:
তালিবান আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা নেতা ও আমীরুল মুমিনিন মোল্লা ওমর মুজাহিদ ২৩শে এপ্রিল, ২০১৩-এ মহান রবের ডাকে সাড়া দিয়ে ক্ষনস্থায়ী এই পৃথিবী ছেড়ে আপন রবের কাছে চলে যান। এরপর তালিবান আন্দোলনের শুরা কাউন্সিল ও প্রশাসনিক কর্মকর্তারা মোল্লা মনসুরের প্রতি আনুগত্যের বায়াত করেন । তবে কৌশলগত কারণে ৩০ জুলাই ২০১৫ পর্যন্ত মোল্লা মানসুরের নেতৃত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা থেকে বিরত থাকে তালিবান নেতৃবৃন্দ। ফলে প্রায়াত আমীরুল মুমিনিনের মৃত্যুর প্রায় ২ বছর পরে বিষয়টি প্রকাশ করেন মুজাহিদ উমারাগণ।
ইমারাতে ইসলামিয়ার দুঃসময়ে হাল ধরা কিংবদন্তি নেতার শাহাদাত বরণ:
আজ থেকে ৬ বছর পূর্বে আজকের এই দিনে শাহাদাত বরণ করেন ইমারাতে ইসলামিয়ার দুঃসময়ের হাল ধরা কিংবদন্তি নেতা মোল্লা আখতার মুহাম্মদ মানসুর (রহিমাহুল্লাহ্)। জানা যায় যে ২২ মে, ২০১৬ তারিখে, পাক-আফগান সীমান্তের বেলুচিস্তান অঞ্চলে মোল্লা মানসুরের গাড়িকে লক্ষ্য করে ড্রোন হামলা চালায় ক্রুসেডার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পাকিস্তান সীমান্তে ঘটে যাওয়া এই হামলায় মোল্লা মানসুর শাহাদাত বরণ করেন (ইনশাআল্লাহ)।
যেমন ছিলেন এই কিংবদন্তি নেতা:
ইসলাম ও শাহাদাতপ্রিয় তরুণদের আত্মত্যাগ আর রক্তে সিক্ত হয় আফগানের মাটি। আর মোল্লা মানসুর তরুণদের এই প্রচেষ্টা, কর্ম ও ত্যাগকে বৃথা যেতে দেননি। তিনি মুজাহিদদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হেঁটে যেতেন এক ময়দান থেকে অন্য ময়দানে। তিনি কখনো নিজেকে তরুণ মুজাহিদদের থেকে উচ্চতর মনে করতেন না! নেতৃত্বের সময় যৌবনের পবিত্র চেতনাকে মরে যেতে দেননি। যা জিহাদি অঙ্গনে তাঁর সংগ্রাম ও ত্যাগের সাক্ষী বহন করে।
কূটনৈতিক ময়দানেও বিশ্বকে অবাক করে দেন তিনি। জিহাদের ময়দানগুলোতে নতুন উদ্যোম আনেন। মুজাহিদদের উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য তিনি দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্প তৈরি করেন। তিনি দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে এগিয়ে নিয়ে যান সমানতালে। এবং আন্তর্জাতিক সেক্যূলার ও কুফ্ফারদের মিথ্যা প্রচারমাধ্যমগুলোকে চ্যালেঞ্জ করেন। বিশ্বমঞ্চে তিনি ইমারাতে ইসলামিয়ার কূটনীতিকে এমন এক অবস্থানে নিয়ে গিয়েছেন যে, যার ফলে সামরিক অঙ্গনে পরাজয়ের পাশাপাশি রাজনৈতিক অঙ্গনেও পরাজিত হয়েছে কুফ্ফাররা।
শহীদ মোল্লা আখতার মোহাম্মাদ মানসুর রহিমাহুল্লাহ্ তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ইসলামী শাসনব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা জারি রেখেছিলেন।
লিখেছেন : ত্বহা আলী আদনান