ব্যাংক মালিকরাই ব্যাংক-ডাকাত

    0
    878

    আপনার কষ্ট করে জমানো টাকা কি কোনো চোরের কাছে গচ্ছিত রাখবেন? ছলে-বলে-কৌশলে মানুষের টাকা মেরে দেয়, এমন কোনো বাটপারের কাছে আমানত হিসেবে রাখবেন আপনার পরিশ্রমের টাকা? নিশ্চয়ই রাখবেন না। আপনি টাকা রাখবেন বিশ্বস্ত কারো কাছে। আর তাই, নিজেদের বিশ্বস্ত হিসেবে জানান দিয়ে আপনার দরজায় এসেছে নানা নামের ব্যাংক। নিজেদের বিশ্বস্ততা জানান দিতে বিভিন্ন স্লোগানও ব্যবহার করছে তারা। কোনো কোনো ব্যাংকের নামের সাথেও আবার ‘ট্রাস্ট’ শব্দটা লাগিয়েছে। কেউ কেউ আবার ইসলামের নাম দিয়ে নিজেদের বিশ্বস্ত প্রমাণ করতে চেয়েছে। কিন্তু আসলেই কি তারা বিশ্বস্ত? নাকি মানুষের কষ্টার্জিত টাকা মেরে দেওয়ার ধান্দা নিয়েই ছিঁচকে চোর থেকে পুকুর চুরিতে নেমেছে তারা?

    বাংলাদেশে এখন ৬টি রাষ্ট্রয়াত্ত ব্যাংক এবং ৪৩টি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকসহ মোট তালিকাভুক্ত ব্যাংক রয়েছে ৬১টি, আর অ-তালিকাভুক্ত রয়েছে ৫টি ব্যাংক। সাধারণভাবে দেখলে, ব্যাংকের কাজ প্রধানত দুইটি:

    ১. সাধারণ মানুষের সঞ্চয় এবং প্রতিষ্ঠানের উদ্বৃত্ত অর্থ আমানত হিসেবে সংগ্রহ করে পুঁজি গড়ে তোলা,

    ২. সেই পুঁজি ব্যবসায়ীদের ঋণ হিসেবে প্রদান করা।

    বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে খোঁজখবর রাখেন কিংবা ব্যাংকিং সেক্টরের সাথে কোনো-না-কোনোভাবে সম্পৃক্ত ব্যক্তি মাত্রই জানেন, বর্তমানে বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরে ধস নেমেছে। অনেক ব্যাংক ইতোমধ্যে ঋণ নিয়ে চলছে। অর্থাৎ, এসব ব্যাংকে সাধারণ মানুষের রাখা জমানো টাকাগুলো শেষ করে ফেলেছে ব্যাংক মালিকরা। নগদ সংকটে পড়ায় কথিত ইসলামি ধারার ৫টি ব্যাংক তারল্য সহায়তার অংশ হিসেবে গত ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এর পরদিন আরও ১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে ইসলামি ব্যাংক বাংলাদেশ ও গ্লোবাল ইসলামি ব্যাংক। কিন্তু কয়েক দিনেই টাকা ধার নেওয়ার বন্ড শেষ হয়ে যায় ইসলামী ব্যাংকের। ফলে তারল্য সংকট আরও প্রকট হওয়ায় বছরের শেষ কার্যদিবসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ৮,০০০ কোটি টাকা ঋণ পেয়েছে ইসলামি ব্যাংক।

    ব্যাংকগুলো কেন তারল্য সংকটে পড়ছে? কীভাবে জনগণের আমানতের টাকা ব্যাংক থেকে নাই হয়ে যাচ্ছে?

    সম্প্রতি দেশের বৃহত্তম ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান ইসলামি ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ কেলেঙ্কারির পর ব্যাংকিং খাতের তারল্য সংকটের খবর ব্যাপকভাবে জনগণের সামনে আসে। অবশ্য আগে থেকেই নড়বড়ে ব্যাংকিং খাতের ধস নিয়ে সতর্ক করছিলেন সচেতন ব্যক্তিরা। কিন্তু সংশ্লিষ্ট হর্তাকর্তারা সব জেনেও চুপ থাকার নীতি অবলম্বন করেছে।

    ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলো ইসলামের নাম নিয়ে জনগণের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ পুঁজি সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়। এখন ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোই যখন ঋণ নিয়ে চলছে, তখন জনমনে আতঙ্কের সৃষ্টি হওয়াই স্বাভাবিক। যার কারণে ব্যাংক থেকে নিজেদের গচ্ছিত টাকা উঠিয়ে নেওয়ার জন্য ভিড় করছেন জনগণ। এ অবস্থায় অনেক ব্যাংক টাকাও দিতে পারছে না। ফলে আতঙ্ক আরও বেড়েছে। আর মানুষ নিজেদের টাকা উঠিয়ে নেওয়ার কারণে ব্যাংকগুলোতে পুঁজি আরও কমে গেছে।

    দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের ১১ ব্যাংক সামগ্রিকভাবে ৩২ হাজার ৬০৬ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে।

    ব্যাংকের উপর আস্থা রেখে জনগণ নিজেদের জীবনের সব সঞ্চয় রাখতেন সেখানে। কিন্তু ব্যাংকগুলো জনগণের আস্থার প্রতিদান দিয়েছে টাকা উধাও করে দিয়ে। তারা ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে মানুষের জমানো টাকা লুটপাট করে শেষ করেছে।

    নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে বড় বড় প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে বড় অংকের ঋণ প্রদান করেছে ব্যাংকগুলো। সম্প্রতি কেবল ৪টি গ্রুপকে ২১ হাজার ৬৩ কোটি ৫৮ লাখ টাকা ঋণ প্রদান করেছে ইসলামি ব্যাংক ও জনতা ব্যাংক। এই ঋণের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৫৭ দশমিক ৪ শতাংশ নিয়েছে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম ও তার পরিবারের ৪ সদস্য। ঋণ নেওয়া অন্য ৩ গ্রুপ হলো এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার ও তার স্ত্রী, আইএফআইসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান এবং এসবিএসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবদুল কাদির মোল্লা।

    এস আলম গ্রুপ সম্প্রতি ইসলামি ব্যাংক থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়ে আলোচনায় রয়েছে।
    অথচ ব্যাংকিং নিয়ম অনুযায়ী, এস আলম গ্রুপ এবং এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো ইসলামি ব্যাংক থেকে সর্বোচ্চ ২১৫ কোটি টাকা নিতে পারে।

    বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, বর্তমানে প্রচলিত ধারার ব্যাংক ১০০ টাকা আমানতের বিপরীতে ৮৭ টাকা এবং ইসলামি শরিয়াভিত্তিক ব্যাংক ৯২ টাকা পর্যন্ত ঋণ বা বিনিয়োগ করতে পারে। কিন্তু অনেক ব্যাংক উল্লিখিত সীমা অতিক্রম করে ঋণ দিয়েছে। দেখা গেছে, প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলো ৮৮ থেকে ৯২ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ দিয়েছে। আর ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলো দিয়েছে ৯৭ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ। অর্থাৎ, মানুষের কষ্টের টাকা এই ব্যাংকগুলো নিজেদের ইচ্ছেমতো ঋণ দিয়ে শেষ করেছে। আর যাদেরকে ঋণ দিয়েছে, সেই ঋণ আবার তাদের থেকে আদায়ও করতে পারছে না। কীভাবে করবে? যারা ঋণ নিয়েছে তারাই তো এসব ব্যাংকের হর্তাকর্তা!

    বাংলাদেশের মানুষের সবচেয়ে বেশি আস্থা অর্জন করতে পেরেছিল ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলো। এজন্য এই ব্যাংকগুলোতে মানুষ আমানতও বেশি রেখেছিল। কিন্তু ইসলামি ধারার এই ব্যাংকগুলো মূলত এস আলম গ্রুপের মতো চোরদের অধীনে। ইসলামি ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামি ব্যাংক (এসআইবিএল), ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামি ব্যাংক (এফএসআইবিএল), গ্লোবাল ইসলামি ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক—এই ৫ ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ডই এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন। আবার এই এস আলম গ্রুপই কিন্তু ইসলামি ব্যাংক থেকে সর্বোচ্চ ঋণ নিয়েছে। অর্থাৎ, ইসলামি ব্যাংকের মালিকরাই ইসলামি ব্যাংক থেকে জনগণের জমানো টাকাগুলো ঋণের নামে লুটপাট করেছে।

    পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, “এস আলম গ্রুপ অর্থনৈতিক আগ্রাসন চালিয়ে একটি ব্যাংকের টাকা দিয়ে আরেকটি ব্যাংক কিনেছে। এখন এসব তথ্য বের হয়ে আসছে। কিন্তু ব্যাংকিংখাত সংশ্লিষ্টরা, ব্যাংকিং মহলে, দেশের অর্থনৈতিক নীতি-নির্ধারক পর্যায়ে অনেকের বিষয়টি জানা ছিল।” এমনকি করোনা মহামারির আগে এক মিটিংয়ে তৎকালীন গভর্নরের সামনে বিষয়টি উত্থাপন করা হলেও গভর্নর নীরব থেকেছেন বলে জানান আহসান এইচ মনসুর।

    তিনি বলেন, “সেই সময় তৎকালীন গভর্নরকে মজা করে বলেছিলাম, এস আলম গ্রুপের মালিকের সঙ্গে একটি অ্যাম্বুলেন্স সার্বক্ষণিক রাখার ব্যবস্থা করেন। যাতে তিনি কোনো কারণে হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেও দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া যায়, তাকে বাঁচিয়ে রাখা যায়। নইলে তিনি মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের ব্যাংকিংখাত ধসে যাবে। একজন মানুষের কার্যক্রমে পুরো দেশের ব্যাংকিংখাত ধ্বংসের মুখে পড়তে পারে।”

    কেবল এস আলম গ্রুপের হাতে দেশের মানুষের কত টাকা জমা হয়েছে, তা এই বক্তব্য থেকেই চিন্তা করা যায়। তারা দেশের মানুষের এতগুলো টাকা নিয়ে বিদেশে হোটেল কিনে। সিঙ্গাপুরে এস আলম গ্রুপের মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের ৩টি হোটেল আছে এবং আরও কেনার প্রক্রিয়া চলছে।

    একইভাবে এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারও জনগণের জমানো টাকা মেরে দিচ্ছে নিয়মিত। লেবাসে দরবেশ সেজে শয়তানিতে পাঁকা এই ব্যক্তি আবার বেসরকারি ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস-এর সভাপতি। এই লোকের প্রভাব এত বেশি যে, যুগান্তর পত্রিকায় তাঁর দুর্নীতি, অপকর্ম ফাঁস করে প্রকাশিত সংবাদটি পর্যন্ত উঠিয়ে নিতে বাধ্য করেছে পত্রিকাটিকে।

    মোহাম্মদ সাইফুল আলম এবং নজরুল ইসলাম মজুমদারের মতো সালমান এফ রহমান ও আবদুল কাদির মোল্লাও জনগণের কষ্টার্জিত টাকাগুলো নিজেদের আরাম-আয়েশে ইচ্ছেমতো ব্যবহার করছে। দুর্নীতিবাজ ‘দরবেশ’ সালমান এফ রহমান শেয়ার কেলেংকারি, ঋণ খেলাপি, অর্থ পাচারসহ নানা অপরাধে জড়িত। আর শিল্পপতি আব্দুল কাদির মোল্লা মানুষের জমানো টাকা বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণের নামে তুলে নিয়ে ক্ষুদ্র একটা অংশ দান করে দানবীর হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে, কিন্তু ব্যাংকের ঋণ ফেরত দিতে খুবই অনীহা তার। এর আগে, তিতাস গ্যাসে চাকরি করার সময়ও ব্যাপক দুর্নীতি করে দুর্নীতিবাজদের খাতায় নাম লিখিয়েছে এই আব্দুল কাদির মোল্লা।

    এখানে ব্যাংক থেকে নীতি ভঙ্গ করে অস্বাভাবিক হারে ঋণ নেওয়া চারজন ব্যক্তির কথা বলা হলো।  অবাক করা বিষয় হলো, তারা প্রত্যেকেই এক বা একাধিক ব্যাংকের মালিক! তারা যেহেতু মালিক, নীতি ভঙ্গ করে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের আর বাধা দেবে কে?

    তার উপর কথা হলো, তারা ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের একান্ত অনুচর; লুটের মালে ক্ষমতাসীন পরিবারের অংশ থাকার বিষয়েও ব্যাপক গুঞ্জন রয়েছে। একারণে বড় বড় দুর্নীতি, চুরির ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও তারাই আবার এখন ‘বিশ্বস্ত’ ব্যাংকের মালিক! বাংলাদেশের অন্যান্য ব্যাংকের মালিকরাও তাদের মতোই ‘বিশ্বস্ত’! এভাবে ব্যাংক মালিকরা সবাই মিলেমিশে জনগণের টাকাগুলো আমানত হিসেবে নিয়ে খেয়ানত করতে বিলম্ব করছে না। এখন জনগণের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত, তারা এসব চোর-ডাকাতদের হাতে নিজেদের টাকা আমানত হিসেবে রাখবে কি না।



    লিখেছেন : সাইফুল ইসলাম

    মন্তব্য করুন

    দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
    দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

    পূর্ববর্তী নিবন্ধকর্ণাটকে ‘গোহত্যা’ ও ‘লাভ জিহাদ’ সংক্রান্ত কঠোর আইনের দাবি
    পরবর্তী নিবন্ধআশ-শাবাবের কাছে পরপর দুটি বড় সামরিক পরাজয় সোমালি বাহিনীর