
গুমের শিকার হয়ে ফিরে আসা ব্যক্তিরা এখন নতুন চাপের মুখে রয়েছেন। তাদের অচেনা ফোন নম্বর থেকে ভয় দেখানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে, তারা যেন গুমের ঘটনার বিষয়ে মুখ না খোলেন এবং কোনো অভিযোগ যেন না করেন- সে বিষয়েও তাদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
শেখ হাসিনার শাসনামলে গুম ও রাষ্ট্রীয় নির্যাতন ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল। র্যাব ও কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) পাশাপাশি পুলিশ সদর দপ্তরের এলআইসি শাখাও বহু নিরীহ আলেম এবং সাধারণ মানুষকে গুম করেছিল। এমনই কজন ভুক্তভোগীর মধ্যে রয়েছেন মুফতি মো. যায়েদুর রহমান ও ইকবাল হোসেন সরকার। যাদের গুমের পর দীর্ঘ সময় আটকে রাখা হয়েছিল। তারা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, গুমের পর অনেককে বগুড়া পুলিশ লাইনসের গোপন কারাগারে আটকে রেখে সুবিধাজনক সময়ে জঙ্গি নাটক সাজিয়ে গণমাধ্যমের সামনে হাজির করা হতো।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা অভিযোগে তারা বলেন, গুমের ঘটনায় সরাসরি জড়িত ছিলেন পুলিশ সদর দপ্তরের এলআইসি শাখার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার দেবাশীষ দাশ, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নূরে আলম এবং পুলিশ সুপার মীর আবু তৌহিদ, বগুড়া ডিবি পুলিশের এএসপি আরিফুর রহমান মণ্ডল (পরবর্তীতে সিরাজগঞ্জের এসপি), এসআই জুলহাজ উদ্দীন, এসআই ওয়াদুদ আলী, এসআই ফিরোজ সরকার, এএসআই রানা হামিদ, এএসআই মিন্টু মিয়া, আসলাম আলী ও এসআই আক্তারসহ বেশ কজন।
সম্প্রতি জামিনে মুক্ত হয়ে গণমাধ্যমেকে জানিয়েছেন, তাদের ওপর চাপ দেওয়া হচ্ছে যাতে তারা গুমের বিষয়ে চুপ থাকেন এবং কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ না করেন। অজ্ঞাত নম্বর থেকে তাদের এবং পরিবারের সদস্যদের হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে।
তারা আরো অভিযোগ করেন, গুম-সংক্রান্ত কমিশনে অভিযোগ দাখিলের পরপরই অতীতের সাজানো মামলাগুলোর রায় দ্রুত দেওয়ার জন্য পুলিশ তড়িঘড়ি শুরু করেছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, যারা গুমে জড়িত ছিলেন, তাদের বেশিরভাগই এখনো নিজ নিজ পদে বহাল রয়েছেন, ফলে ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে আশঙ্কায় রয়েছেন।
মোবাইলে টাকা পাঠিয়ে প্রলোভন দেখানো হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন অনেকে।
দীর্ঘ গুম, মিথ্যা মামলা
মাদরাসাশিক্ষক মুফতি যায়েদুর ও তার ব্যবসায়ী অংশীদার ইকবালকে ২০১৯ সালের ১০ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকা থেকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়। এরপর দীর্ঘ ১৯ মাস তাদের গুম রেখে নানারকম নির্যাতন চালানো হয়। পরে সাজানো নাটকের মাধ্যমে ২০২০ সালের ২৭ নভেম্বর বগুড়া থেকে তাদের গ্রেপ্তার দেখিয়ে তিনটি মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়। ৫ আগস্ট হাসিনার পতনের পর তারা জামিনে মুক্ত হন।
যায়েদুর গণমাধ্যমকে বলেন, আমাকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গিয়ে চোখ বাঁধা অবস্থায় অকথ্য নির্যাতন করা হয়। দীর্ঘ ১৯ মাস পরিবার আমার কোনো খোঁজ পায়নি। এক পর্যায়ে হঠাৎ করে আমাকে বগুড়ায় উদ্ধার দেখিয়ে জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
ভুক্তভোগী ইকবাল গণমাধ্যমকে বলেন, গুমের পর ১৯ মাস পরিবারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করতে দেওয়া হয়নি। এখনো আমরা চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছি। গুমের পর আমার পরিবারের সদস্যরা থানায় জিডি, র্যাব-১১তে আবেদন, সংবাদ সম্মেলন, এমনকি জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনেও আবেদন করেন। দীর্ঘ ১৯ মাস পর ২০২০ সালের ২৭ নভেম্বর বগুড়া জেলার গোকুল এলাকায় জঙ্গি নাটক সাজিয়ে আমাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয় এবং মিথ্যা মামলায় কারাগারে পাঠানো হয়।
গুমে জড়িতরা এখন ইকবালের স্ত্রী হাবিবা আক্তারসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের বিভিন্নভাবে হুমকি দিচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী।
হাবিবা আক্তার গণমাধ্যমকে বলেন, আমার স্বামীর জামিনের আগেও বিভিন্ন হুমকি দেওয়া হয়েছিল। আমাদের ফোন করে হুমকি দেওয়া হয়েছে, যেন গুম-সংক্রান্ত কমিশনে আবেদন না করি; কিংবা সরকারের কোথাও কোনো সংবাদ সম্মেলন না করি। অভিযোগ করলে পুলিশ জামিনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে, এমনকি পুলিশ ক্লিয়ারেন্সও দেবে না। জামিনে মুক্ত হওয়ার পর এখন আমার স্বামীকে অপহরণের সময়কার সাক্ষীকে টেলিফোনে হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
জাতিসংঘের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ এবং হিউম্যান রাইট ওয়াচ ২০২১ সালে গুমের যে তালিকা দিয়েছিল, তাতে এই দুই আলেমের নামও ছিল। জাতিসংঘের হিসাবে গুম হওয়া ৭৬ জনের মধ্যে ৫৯ ও ৫৮ নম্বরে ছিল যথাক্রমে যায়েদুর ও ইকবালের নাম।
যায়েদ ও ইকবালের মতোই গুম থেকে ফেরা অনেকেই টেলিফোনে হুমকিসহ নানা সামাজিক বিড়ম্বনায় পড়ছেন। এমনই একজন ভুক্তভোগী সাবেক রাষ্ট্রদূত এম মারুফ জামান। গুম থেকে ফিরে অর্থনৈতিক, মানসিক ও শারীরিক নানা সমস্যায় ভুগছেন তিনি। মারুফ জামান আমার দেশকে বলেন, গুম থেকে ফিরে এখনো নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ভুগছি।
নিরাপত্তাহীনতার কথা জানালেন ‘গুমনামা’ বইয়ের লেখক হুমায়ুন কবির, যিনি জুলভার্ন নামে ব্লগে লিখতেন। ‘লেখালেখির অপরাধে’ দীর্ঘ ১১ দিন গুম করে রাখা হয় তাকে। এরপর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে চার মামলায় প্রায় ছয় মাস কারাগারে ছিলেন তিনি।
দুর্ভোগ ও আইনি লড়াই
গুমের শিকার অনেকের পরিবার অর্থনৈতিকভাবে চরম দুরবস্থায় পড়েছেন। যায়েদুর বলেন, আমার স্ত্রী স্ট্রোক করে অসুস্থ হয়ে পড়েন। গুমের সময় কারাগার থেকে ফোন করে টাকা দাবি করা হতো। ফলে আমার পরিবার ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। অনেকেই দীর্ঘ সময় কারাগারে থেকে হার্ট ও কিডনি সমস্যায় ভুগছেন।
তথ্যসূত্র:
১. আমার দেশ অনুসন্ধান: গুম থেকে ফিরে নতুন চাপে তারা
– https://tinyurl.com/48vrjzum


