আফ্রিকায় নিয়োজিত পেন্টাগনের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা বুধবার দাবি করছে যে, ২০২০ সালে রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে সোমালিয়ায় অবস্থানরত মার্কিন সৈন্যদের প্রত্যাহার করা হয়। এর ফলে সোমালিয়ায় আল-কায়েদার অবস্থান অনেকগুণে “শক্তিশালী হয়েছে, আরও বিস্তৃত হয়েছে এবং আরও সাহসী হয়ে উঠেছে”।
সম্প্রতি ক্রুসেডার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আফ্রিকা কমান্ডের কমান্ডার জেনারেল স্টিফেন টাউনসেন্ড, স্টুটগার্টে কমান্ডের সদর দফতরে সাংবাদিকদের সাথে একটি বৈঠক করে। এসময় সে দাবি করে যে, সোমালিয়া থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের পর, আশ-শাবাব দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে পুনর্গঠিত হয়েছে, উন্নতি করেছে। হর্ন অফ আফ্রিকা অঞ্চলে এর কার্যক্রম ও ক্ষমতা বাড়িয়েছে। আফ্রিকান রাষ্ট্রগুলোর সম্মিলিত জোটের কিছু উন্নত ঘাঁটি দখল করেছে। যার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান সন্ত্রাসী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সম্প্রতি দেশে ফেরত সেনাদেরকে পুনরায় সোমালিয়ায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমেরিকান কর্মকর্তারা বলছে যে, এই সিদ্ধান্ত সোমালিয়ায় স্থায়ী উপস্থিতি বজায় রেখে ক্রমবর্ধমান কথিত “সন্ত্রাসী হুমকি” কমানোর একটি পদক্ষেপ। এই সিদ্ধান্তের পরিধির মধ্যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সোমালিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি পাল্টাতে প্রায় ৫০০ সেনা পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আশ-শাবাবের সামরিক সক্ষমতা বেড়েছে :
মার্কিন সামরিক কর্মকর্তারা মনে করেন, ট্রাম্প-যুগে সোমালিয়ায় যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তার কারণে জটিল সব হামলা চালানোর সক্ষমতা কয়েকগুণে বেড়েছে আশ-শাবাবের। তাঁরা পূর্বের চাইতে আরও শক্তিশালী ও সুসংগঠিত। এটি অনুমান করা হয় যে, চলতি বছরের মে মাসে শুরু হওয়া তীব্র সংঘর্ষে আশ-শাবাবের হামলায় জাতিসংঘের কথিত “শান্তিরক্ষী” বাহিনীর অন্তত ৩০ সৈন্য মারা গিয়েছে। একই মাসে রাজধানী মোগাদিশু থেকে মাত্র ১৫০ কিলোমিটার দূরে আফ্রিকান ইউনিয়নের ফরোয়ার্ড অপারেশন বেস আশ-শাবাব বিজয় করেছিল। এই মাসেই দেশটিতে অনুষ্ঠিত হয় নতুন সরকার নির্বাচন। যখন নির্বাচনের নির্ধারিত দিন ঘনিয়ে আসতে থাকে, আশ-শাবাব তখন তাদের আক্রমণও জোরদার করে। এরই প্রেক্ষিতে রাজধানীর বিমানবন্দরের কাছে শহিদী হামলা চালান হারাকাতুশ শাবাব মুজাহিদিন। যাতে বহু সংখ্যক গাদ্দার সৈন্য নিহত হলেও সরকার মাত্র চারজন নিহত ও সাতজন আহত হওয়ার কথা স্বীকার করে।
মার্কিন জেনারেল টাউনসেন্ড, ফরেন পলিসি এবং স্টুটগার্টে আফ্রিকান কমান্ডের কেলি ব্যারাকের আরেক সাংবাদিকের সাথে একটি সাক্ষাতকারে বলেছে, “সোমালিয়া থেকে বেরিয়ে আসার সাথে সাথে আমরা যে পুনঃনিয়োগ কার্যক্রম শুরু করেছি, তা শেষ করার পর থেকে গত ১৬ মাসে আশ-শাবাব আরও শক্তিশালী, বিস্তৃত এবং আরও সাহসী হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে আমরা দেখেছি যে, আমি সেখানে অবস্থান নেওয়ার তিন বছরে গ্রুপটি যেসব হামলা চালাতে সক্ষম হয়নি, এখন তার চাইতেই আরও কঠিন সব অপারেশন পরিচালনা করছে।”
মার্কিন সেনা প্রত্যাহার পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করেছে :
বিশ্লেষকরা মনে করেন, সোমালিয়ার যুদ্ধের ময়দান থেকে মার্কিন সৈন্যদের প্রত্যাহার সোমালিয় গোলাম সৈন্যদের গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। ফলে সৈন্যরা আশ-শাবাবের বিরুদ্ধে অপারেশন চালানো তো দূরের কথা, তারা প্রতিরোধও গড়ে তুলতে পারেনি। এতে করে একের পর এক শহর ও ঘাঁটি হারিয়েছে সোমালি গাদ্দার সরকার। যদিও এই সময়ে আফ্রিকান ইউনিয়নের সৈন্যরা গাদ্দার সোমালিয় সৈন্যদের সাহায্য করেছিল, কিন্তু তা আশ-শাবাবকে প্রতিহত করতে যথেষ্ট নয়। বরং এই সময়েই আফ্রিকান ইউনিয়ন তাদের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ঘাঁটি আশ-শাবাবের হাতে ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। কিছু কিছু স্থানে তো আশ-শাবাব কোন যুদ্ধ ছাড়াই সামরিক ঘাঁটি ও এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।
এবিষয়ে টাউনসেন্ড অস্বীকার করেছে যে, সোমালিয় সামরিক বাহিনী “আগের চেয়ে দুর্বল”। কিন্তু সে এটা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে যে, প্রশিক্ষণ ও মনোবলের জন্য সোমালি সৈন্যদের অংশীদারদের প্রয়োজন, যার ফলে তারা ময়দানে কাজ করতে পারবে।
জেনারেল টাউনসেন্ড আরও স্বীকার করে যে, “সোমালিয় সেনারা মোটেও অগ্রসর হয়নি। তাদের এগিয়ে যাওয়ার জন্য সহযোগীদের প্রয়োজন।”
২০২০ সালের জানুয়ারিতে কেনিয়ার ‘মান্দি বে’ মার্কিন সামরিক বিমানবন্দরে বড় আকারের অভিযান চালান আশ-শাবাব মুজাহিদিন। এর এক বছর পরে সোমালিয়া থেকে আমেরিকান সৈন্যরা দেশ ছেড়ে পালায়। আঞ্চলিক রিপোর্ট অনুযায়ী, ট্রাম্পের নির্দেশে সোমালিয়া থেকে সেনা প্রত্যাহার করার পর আশ-শাবাবের আক্রমণ প্রায় ৩০% বৃদ্ধি পেয়েছে।
টাউনসেন্ড নিজের এই পরাজয় ঢাকতে গিয়ে দাবি করে যে, আশ-শাবাবের ক্রমবর্ধমান এই হামলা সত্ত্বেও তারা সোমালিয়ায় নির্বাচন রোধ করতে পারেনি। অথচ সে এটা একেবারেই এড়িয়ে গিয়েছে যে, আশ-শাবাবের হাত থেকে বাঁচতে সরকারি এই নির্বাচন সংঘটিত হয়েছে একটি সামরিক ঘাঁটির ভিতরে কড়া পাহাড়ার মধ্য দিয়ে। যেখানে ১ কোটি ৬৩ লাখ জনসংখ্যার দেশটির মাত্র কয়েক হাজার লোক এতে অংগ্রহন করেছে। তারপরও মার্কিন এই জেনারেল দাবি করছে আশ-শাবাব নির্বাচন রোধ করতে পারেনি!
আল-কায়েদার সক্রিয় শাখাগুলোর মধ্যে আশ-শাবাব বৃহত্তম :
আশ-শাবাব পূর্ব আফ্রিকা ভিত্তিক আল-কায়েদা সংশ্লিষ্ট একটি ইসলামি প্রতিরোধ বাহিনী। মার্কিন জেনারেল টাউনসেন্ডের মতে “আল কায়েদার সক্রিয় শাখাগুলির মধ্যে আশ-শাবাব এখন বৃহত্তম, ধনী এবং সবচেয়ে মারাত্মক একটি সামরিক বাহিনী।” দলটি তাঁর নতুন ভিডিওগুলোতে আমেরিকার মাটিতে আক্রমণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করে চলেছে৷ একইভাবে পশ্চিম আফ্রিকা ভিত্তিক ‘জেএনআইএম’ও আমেরিকা ও ফ্রান্সকে হুমকি দিয়ে আসছে। অন্যদিকে পেন্টাগন মনে করে, এ ধরনের হামলা চালানোর সক্ষমতা এখনো আশ-শাবাবের হয়নি। তবে এটি নিশ্চিত যে, আশ-শাবাব হর্ন অফ আফ্রিকা অঞ্চলে যেকোনো বড় ধরণের অভিযান চালাতে সক্ষম। এর প্রমাণ তাঁরা ২০১৫ সালে কেনিয়ায় অভিযান শুরু করার মাধ্যমেই দিয়েছেন। যেখানে দেশটির সীমান্তবর্তী অনেক অঞ্চল ও জেলা নিয়ন্ত্রণ করছে আশ-শাবাব। দেশটিতে তাঁরা এমন সব বীরত্বপূর্ণ অপারেশনও পরিচালনা করছেন, যার এক একটিতে শত শত সেনা নিহত এবং আহত হয়েছে।
এদিকে মে মাসের শুরুতে আশ-শাবাবের মিডিয়া থেকে প্রকাশিত একটি ভিডিওটিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একাকী হামলার মাধ্যমে আক্রমণ (Lone Wolf Attack) এবং সারা বিশ্বে আমেরিকান ও পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে জিহাদের আহ্বান জানানো হয়েছে।
ধারণা করা হচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে আল-কায়েদা সংশ্লিষ্ট পশ্চিম আফ্রিকা ভিত্তিক শাখা জেএনআইএম ও পূর্ব আফ্রিকা ভিত্তিক শাখা আশ-শাবাব পশ্চিমা ও ইউরোপীয়দের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠবে। ইতিমধ্যে দল দু’টি কুফ্ফার জোটগুলোকে হুমকি দেওয়ার পাশাপাশি নিজেদের সক্রিয় অঞ্চলগুলোতে পশ্চিমা ও ইউরোপীয় বিভিন্ন দখলদার কোম্পানি ও কর্মকর্তাদের লক্ষ্যবস্তু বানাতে শুরু করেছে।
প্রতিবেদক : ত্বহা আলী আদনান
তথ্যসূত্র:
1. انتخابات الصومال : حيث لا يصوت الشعب
– https://tinyurl.com/5ajra2na
2. US AFRICOM Chief: Al-Shabaab gets ‘bigger, stronger and bolder’
– https://tinyurl.com/mrxbzzvf
আল্লাহ আপনাদের উভয় জগতের কল্যান দান করেন