আফগানিস্তানে দীর্ঘ বিশ বছর মার খেয়ে পরাজিত হয়ে, গত বছর আগস্টে দেশটি থেকে সেনা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় ক্রুসেডার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যুদ্ধের খরচ চালাতে গিয়ে ঋণের চাপে প্রায় দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম হয়েছে ক্রুসেডার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকার টুইন টাওয়ারে হামলার প্রতিক্রিয়ায় কোন ধরণের তথ্য প্রমাণ ছাড়াই গায়ের জোরে তৎকালীন বুশ প্রশাসনের শক্তিধর সশস্ত্র বাহিনী আফগানিস্তানে আক্রমণ চালায়। ৭ অক্টোবর অভিযান শুরু করে মাত্র দুই মাসের মধ্যে তৎকালীন তালিবান সরকারের পতন ঘটিয়ে মার্কিনিরা আফগানিস্তান দখল করে নেয়। এরপর তারা সুদীর্ঘ ২০ বছর তাবেদার সরকারের মাধ্যমে এ দখলদারিত্ব কায়েম রাখে। এজন্য তারা অজস্র অর্থ-সম্পদ, অস্ত্র ও যন্ত্রপাতি এবং জনবল ক্ষয় করে।
কিন্তু এই ব্যয়বহুল যুদ্ধে ক্রুসেডার মার্কিনিরা চূড়ান্ত বিচারে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। গত ৩১ আগস্ট ২০২১সালে শূন্য হাতে আফগানিস্তান থেকে শেষ সৈন্যটি প্রত্যাহার করে নেয় তারা।
অথচ যুক্তরাষ্ট্রের চারজন প্রেসিডেন্ট দুই দশক ধরে রক্তক্ষয়ী এ ব্যয়বহুল যুদ্ধ পরিচালনা করেছে। সূত্র মতে, যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের পুনর্গঠনে যত টাকা খরচ করেছে, তার ৬০ শতাংশ বেশি খরচ করেছে আফগান সেনা এবং নিরাপত্তা বাহিনী গঠনে। গত ২০২০ সাল পর্যন্ত এই খাতে সন্ত্রাসী যুক্তরাষ্ট্রের মোট খরচ ছিল প্রায় ৮ হাজার ৯০০ কোটি ডলার।
এদিকে, করোনাভাইরাস মহামারীর এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ঋণের বোঝা আরো কয়েকগুণ বেড়ে যায়। মহামারীর কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠতে ওয়াশিংটন বেপরোয়াভাবে ব্যয় করেছে। ২০১৯ সালের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ঋণ বেড়েছে প্রায় সাত লাখ কোটি ডলার। মূলত যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে গভীর দুরাবস্থা চলছে এখন। মোট সরকারি ঋণের পরিমাণ প্রথমবারের মতো ৩০ লাখ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে তাদের।
নিজেদের ঋণ মেটাতে ক্রুসেডার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগান রাষ্ট্রটির ১০ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ বাজেয়াপ্ত করে রেখেছে। এবং দেশটির উপর নিষেধাজ্ঞা বজায় রেখেছে। অন্যদিক থেকে আফগানিস্তানের নতুন প্রশাসনকে রাজনৈতিক স্বীকৃতি পেতেও বাঁধা দিচ্ছে অ্যামেরিকা।
ফলে নিজেদের জমাকৃত টাকা থাকার পরও সংকটে পড়েছেন আফগান জনগণ।
এর মধ্যে আফগান জনগণকে খাদ্যসংকটে ফেলে মানবতার কথিত ফেরিওয়ালারা দেশটিতে আটকে থাকা আফগানিস্তানের সম্পদের অর্ধেক ৯/১১ হামলায় ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া সিন্ধান্ত নিয়েছে। তাদের এমন অমানবিক সিন্ধান্তের বলি হচ্ছেন আফগান জনগণ।
বিশ্লেষকগণ প্রশ্ন তুলেছেন, কোন যুক্তিতে তারা আফগানদের অর্থ ৯/১১ হামলায় ক্ষতিগ্রস্তদের দিতে পারে? অথচ, হামলায় আফগান জনগণের কোন সংশিষ্টতা তারা প্রমাণ করতে পারেনি। এটা সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে ‘আফগানদের অর্থ লুট করার অভিনব ফন্দি’ হিসেবেই দেখছেন বিশ্লেষকগণ।
এমনিতেই দশকের পর দশক ধরে যুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত আফগানিস্তান। কাবুলের পতনের পর শুধু যুক্তরাষ্ট্রই আফগানদের অর্থ আটক করেনি; বিভিন্ন সংস্থা স্থগিত করেছে আফগানিস্তানে আন্তর্জাতিক সহায়তাও। ফলে চরম আর্থিক সংকটে রয়েছেন আফগানরা।
এবারের শীতে কয়েক লাখ মানুষের পাশাপাশি শিশুরাও অনেক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। আফগানিস্তানের অসহায় মানুষের কাছে জরুরি ভিত্তিতে সহযোগিতা পাঠানো দরকার।
আফগানিস্তানের খাদ্যসংকট কৃত্রিম এবং মানবতার কথিত ফেরিওয়ালাদের অন্যায়ভাবে আরোপিত সব নিষেধাজ্ঞা ও বিপর্যয়কর অতীত কর্মকাণ্ডের ফল। তালিবানদের সাথে ময়দানে টিকতে না পেরে এখন তারা আফগান জনগণের বৈধ অর্থ লুট করে এখন হজম করে ফেলার এই ঘৃণ্য কূটকৌশল নিয়েছে।
কিন্তু দাজ্জালি মিডিয়াগুলো খাদ্যসংকটের কারণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী না করে নির্লজ্জ ও মিথ্যাবাদীর মতো এখনো আফগান তালেবানদের দায়ী করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
একইভাবে সন্ত্রাসবাদী পশ্চিমারা আফ্রিকানদের শায়েস্তা করার প্রকল্প হাতে নিয়েছিল গত শতকে। আফ্রিকা আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এখনো দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও খাদ্যসংকটে ডুবে আছে আফ্রিকানরা।
তবে বর্তমানে পূর্ব আফ্রিকা ও পশ্চিম আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলে ইসলামি প্রতিরোধ আল-কায়েদা মুজাহিদদের তীব্র প্রতিরোধ ও জবাবি হামলার ফলে ঐ অঞ্চলসমুহে কর্তৃত্ব হারাচ্ছে পশ্চিমা ও ক্রুসেডার শক্তি। ফলে মুজাহিদদের দক্ষ নেতৃত্ব ও রণকৌশলে আবার ঘুরে দাড়াচ্ছে আফ্রিকা। ইসলাম ও মুসলিমের কল্যাণে তাঁরা নিজেদের যান-মাল উৎসর্গ করে দিচ্ছেন।
যাহোক, খাদ্যের কৃত্রিম সংকট গত শতকে ৬০ ও ৭০-এর দশকে আফ্রিকায় শুরু হয়েছিল। বিশেষ করে আফ্রিকার সাব সাহারা ও দক্ষিণ আফ্রিকার দেশগুলোর খাদ্য নিরাপত্তা একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছিল। ওদের জমি ছিল, কৃষি ছিল, কিন্তু উৎপাদন ছিল না।
যদিও ওই সময় বিশ্বে খাদ্য উদ্বৃত্ত ছিল। তবে ভূরাজনীতি ও বিশ্বরাজনীতির জটিল ও কুটিল কৌশলের কারণে আফ্রিকানদের খাদ্য দেওয়া হয়নি। খাদ্যসংকট ও সংঘাত থেকে আর পুরোপুরি বের হয়ে আসতে পারেনি আফ্রিকা।
ভিন্ন ভিন্ন সময় বিভিন্ন কারণ থাকলেও, খাদ্যসংকট এখনো বিদ্যমান আফ্রিকার জনসাধারণের মধ্যে। এ মুহূর্তে পূর্ব আফ্রিকার দক্ষিণ সুদান, সোমালিয়া, ইথিওপিয়া ও কেনিয়ার কমপক্ষে ২১ মিলিয়ন মানুষের জরুরি খাদ্য সহায়তা দরকার। আফ্রিকার দেশগুলোতে বিদেশি শক্তির আগ্রাসনে এখনো তারা সংকট কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
তবে বিশ্লেষকগণ বলছেন তালিবান নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তানের অবস্থা আফ্রিকার মতো হবে না। মিত্র রাষ্ট্রগুলো থেকে কিছু খাদ্য সহায়তা পাচ্ছে তালিবানরা।
খাদ্যসংকট তৈরি করে প্রতিপক্ষকে দমানো ক্রুসেডারদের অনেক পুরোনো কৌশল। যুদ্ধের ময়দানে কুলিয়ে উঠতে না পেরে যুক্তরাষ্ট্র সৈন্য প্রত্যাহার করলেও, শেষ অস্ত্র হিসেবে নিষেধাজ্ঞার রাজনীতি প্রয়োগ করেছে তালিবান সরকারের ওপর। আফগানিস্তানের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ভয়াবহ খাদ্যসংকট হওয়ার কথা নয়।
যুদ্ধ ছাড়া ওই অঞ্চলে এমন কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়নি যে, খাবার নিয়ে চারদিকে হাহাকার শুরু হবে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার কারণে বিভিন্ন দেশের সরকার ও আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো আফগান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন স্থগিত রেখেছে। এ কারণে আফগান মুদ্রা ও ডলারের সংকট দেখা দিয়েছে। যা তালেবানদের সততা আর দক্ষতার সাথে দেশ পরিচালনার কারণে সংকট কমে আসতেছে। হয়ত অচিরেই তারা ঘুরে দাঁড়াবে।
আফগানের বরকতময় ভূমিতে উৎপাদন বাড়ানোর প্রতিও জোর দিচ্ছেন তালেবান প্রশাসন। এছাড়া দেশটিতে রয়েছে বিপুল খনিজ সম্পদ যা উত্তোলন করে কাজে লাগাতে মনোযোগী হচ্ছেন ইসলামি ইমারত আফগানিস্তান।
ফলে বিশ্লেষকগণ আশা করছেন, অদূর ভবিষ্যতে তারা নিজেদের প্রয়োজন পূরণ করেও বিশ্বের মাজলুম উম্মাহর পাশে দাঁড়াবেন।
আফগানিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল আটকে দিয়ে আমদানির পথ বন্ধ করে দিয়েছে ক্রুসেডার আমেরিকা। বিদেশে রক্ষিত তহবিলের ওপর তালিবান সরকারের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় খাদ্য আমদানির মূল্য ডলারে পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে খাদ্য আমদানি কমে আসায় বাজারে খাদ্যসংকট ঘনীভূত হয়েছে।
যদি মানবতার বলি আউড়ানো ক্রুসেডাররা এমন অমানবিক কাজ না করতো, জোড় করে রিজার্ভের টাকা আত্মসাৎ না করে আফগানদের প্রাপ্য অর্থ তাদেরকে বুঝিয়ে দিত, তাহলে আল্লাহ্র ইচ্ছায় তালেবানদের সততা, ন্যায় নীতি ও ইসলামিক শাসন ব্যাবস্থার সুফলে আফগান জনগণ ইতিমধ্যেই পৃথিবীর অন্যতম সুখী ও সমৃদ্ধ জাতিতে পরিণত হত।
ইনশাআল্লাহ এখনা না হলেও অতি শীঘ্রই ক্ষুধা ও সংকট মুক্ত একটি অনুকরণীয় রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াবে ‘সাম্রাজ্যবাদীদের কবরস্তান’ খ্যাত আফগানিস্তান- এমনই আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন সচেতন বোদ্ধামহল।
লিখেছেন : মাহমুদ উল্লাহ্