সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাতে গড়ে তুলেছে সম্পদের পাহাড়। আর এর সবই জানতো গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসব দেশে সাইফুজ্জামানের ৬৭ কোটি ৫০ লাখ ডলার বা আট হাজার ১০০ কোটি টাকার সমপরিমাণ সম্পদ রয়েছে বলে উঠে এসেছে আলজাজিরার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে।
গত ১৮ আগস্ট, বুধবার কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর এই বিরাট সম্রাজ্যের বিস্তারিত তথ্য।
যুক্তরাজ্যে বাড়ি কেনার জন্য সাইফুজ্জামান বিভিন্ন কোম্পানি তৈরি করেছে। ২০১৬ সাল থেকে ২০২১ সালের মধ্যে সে দেশটিতে ২৬৫টি বাড়ি কিনেছিল। শুধু ২০২২ সালে সে সেখানে কিনেছে ৮৯টি বাড়ি। সবমিলিয়ে যুক্তরাজ্যে তার বাড়ি রয়েছে ৩৬০টি, যার মূল্য ২৫ কোটি ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা)।
সাইফুজ্জামান ২০১৪ সালে হাসিনা সরকারের ভূমি প্রতিমন্ত্রী এবং ২০১৯ সালে ভূমিমন্ত্রীর দায়িত্ব পায়। এই পদে ২০২৪ সালের ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত বহাল ছিল সে।
প্রতিবেদনে গোপন ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিওতে দেখা যায়, সাইফুজ্জামান যুক্তরাজ্যে তার একটি বিলাসবহুল ও অত্যন্ত নিরাপত্তাবেষ্টিত পাঁচতলা বাড়ি ঘুড়িয়ে দেখাচ্ছে ছদ্মবেশী অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের।
বাড়িটি ঘুড়িয়ে দেখানোর সময় সে সেখানে বলছে, ‘এটা আমাদের সিনেমা হল…এটা আমার নতুন রোলস (রয়েস)…।’
দেশ ছেড়ে পলাতক আওয়ামী এই সংসদ সদস্য দাবী করে, সে শেখ হাসিনার খুবই কাছের ও বিশ্বস্ত মানুষ।
সাইফুজ্জামান বলেছে, ‘আমার বাবা প্রধানমন্ত্রীর (হাসিনা) খুব কাছের মানুষ ছিল। সত্যি বলতে আমিও। সে (হাসিনা) আমার বস।’
ভূমিমন্ত্রী থাকাকালে ২০১৮ সালের জুনে বাংলাদেশের ইউসিবি ব্যাংক দখল করে সাইফুজ্জামান। গত ২৭ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংক ইউসিবির বোর্ড ভেঙে দিলে ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ হারায় সে।
বিদেশে সম্পদ ক্রয়ের ক্ষেত্রে নানান ব্যবসা থেকে আয় এবং ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে সেগুলো কিনছে বলে দেখিয়েছে সাইফুজ্জামান। দুবাইয়ে ব্যবসার মাধ্যমে করা আয় যুক্তরাজ্যে নিয়ে সম্পদ কিনছে, এমনটি দেখানো হলেও বাংলাদেশ থেকেই দুবাইয়ে অর্থপাচার করা হয়েছে বলে উঠে এসেছে প্রতিবেদনটিতে।
এসব সম্পদের কোনো কিছুই সাইফুজ্জামান বাংলাদেশে তার বার্ষিক আয়কর রিটার্ন বা নির্বাচনী হলফনামায় কখনোই উল্লেখ করেনি।
যুক্তরাজ্যে সাইফুজ্জামানের এজেন্ট রিপন মাহমুদ আলজাজিরার অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জানায়, এসব বিনিয়োগ হয় ছোট ছোট অংকে, যাতে সেসব দেশের সরকারের নজরে না পরে যায়।
রিপন জানায়, ‘সাইফুজ্জামান এক কোটি ডলার আনে এবং বলে যে আমি নগদে কিনিনি, ব্যাংক আমাকে টাকা দিয়েছে।’
কেবল যুক্তরাজ্যে নয় যুক্তরাষ্ট্রেও নয়টি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট আছে সাইফুজ্জামানের। এর মধ্যে পাঁচটি নিউইয়র্কের প্রধান এলাকাগুলোতে এবং চারটি নিউজার্সিতে।
আলজাজিরাকে রিপন জানিয়েছে, প্রতি বছর তার মাধ্যমে ১০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করে সাইফুজ্জামান। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় এক হাজার ২০০ কোটি টাকা।
এসব অর্থপাচার এবং বিদেশে বিনিয়োগের জন্য সেসব দেশের ব্যাংক কর্মকর্তা, ফাইন্যান্সার, আইনজীবী, রিয়েল স্টেট কোম্পানি, এজেন্টের সঙ্গে নিয়ে একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিল সাইফুজ্জামান।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়েও সাইফুজ্জামানের রয়েছে অঢেল সম্পদ। সেখানে তার ও তার স্ত্রী রুখমিলা জামানের নামে রয়েছে প্রচুর সম্পত্তি।
দুবাইয়ে তাদের অন্তত ৫৪টি সম্পত্তি রয়েছে।
যুক্তরাজ্যের বাড়িতে বসে আলজাজিরার ছদ্মবেশী সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় দুবাইয়ে তার সম্পদের বর্ণনা দিয়ে সাইফুজ্জামান বলে, ‘আমার সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় বাড়ি আছে। নিউইয়র্ক, ম্যানহ্যাটনে আমার সম্পত্তি আছে।’
সে জানায়, শেখ হাসিনা জানত যে এসব দেশে তার ব্যবসা রয়েছে।
এ সময় আলাপচারিতায় সে জুতা, স্যুটসহ বিলাসবহুল সব পণ্য কিনে থাকে বলে জানায়।
তিন হাজার পাউন্ড বা প্রায় পৌনে পাঁচ লাখ টাকা দামের একেকটি জুতা এবং ছয় হাজার পাউন্ড বা প্রায় সাড়ে নয় লাখ টাকা দামের একেকটি স্যুট সে কিনেছে বলে জানায়।
বাংলাদেশের মুদ্রানীতি অনুযায়ী, দেশের নাগরিকেরা বছরে ১২ হাজার ডলারের বেশি বিদেশে নিতে পারে না।
বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্যে এত টাকা নেওয়ার পদ্ধতি বিষয়ে জানতে চাইলে সে বলেছে, ‘আমার দুবাইয়ে একটা ব্যবসা আছে। সেখানে একটা রিয়েল স্টেটে কেনা-বেচার ব্যবসা করি। দুবাই থেকে এখানে টাকা আনি।’
বাংলাদেশ থেকে দুবাইয়ে কীভাবে টাকা আসে সেটা ব্যাখ্যা করে রিপন জানায়, দুবাইয়ের কোম্পানিগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশি কোম্পানির ব্যবসা দেখিয়ে টাকা নেওয়া হয়।
আলজাজিরার ছদ্মবেশী সাংবাদিক চীন থেকে দুবাইয়ে অর্থ নিতে চায় জানালে হুন্ডির মাধ্যমে এই লেনদেনে সহযোগিতা করার চেষ্টা করবে বলেও জানায় সাইফুজ্জামান।
সাইফুজ্জামানের এজেন্ট রিপন একপর্যায়ে আলজাজিরার সাংবাদিকদের জানিয়েছে, নিউইয়র্ক ও সানফ্রানসিসকোতে সাইফুজ্জামানের দুই কোটি ডলারের স্টক রয়েছে। দুবাইয়ে বিনিয়োগ করা আছে সাড়ে ১৯ কোটি ডলার। লন্ডনে বিনিয়োগ করা আছে ৩০ কোটি ডলার।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, রিপনের তথ্য এবং তাদের অনুসন্ধান মতে বিদেশে সাইফুজ্জামানের মোট সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৬৭৫ মিলিয়ন বা ৬৭ কোটি ৫০ লাখ ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় আট হাজার ১০০ কোটি টাকা।
তথ্যসূত্রঃ
১.যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্র-দুবাইয়ে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামানের প্রায় আট হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি
-https://tinyurl.com/5n8sc3ne
-https://tinyurl.com/ycxxk9n5
