
৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেও তার দোসর পুলিশ কর্মকর্তাদের অনেকেই নানা মাধ্যমে তদবির করে নিজেদের সুরক্ষিত রেখেছে। বিচারের কাঠাগড়ায় দাঁড় করানোর পরিবর্তে উল্টো তাদের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পোস্টিং দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে চাঁনখারপুলে স্কুলছাত্র আনাসসহ ৭ জনকে হত্যায় জড়িত কর্মকর্তারা মামলার আসামি হলেও তাদের এখনো গ্রেফতার করেনি পুলিশ। মাঠে কিলিং বাস্তবায়নকারী রমনা জোনের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) শাহ আলম মো. আখতারুল ইসলামকে সিলেটে বদলি করা হয়। কর্মস্থল থেকে পালিয়ে যায় সে। জুলাই আন্দোলনে হত্যা ও হত্যাচেষ্টা মামলায় সাবেক ও বর্তমান ৯৫২ পুলিশ আসামি হলেও মাত্র ২৮ জন গ্রেফতার হয়েছে। গ্রেফতারের হার মাত্র ২.৯৪ শতাংশ। ৫ আগস্ট-পরবর্তী নতুন বাংলাদেশের বয়স ৭ মাস হতে চললেও গণহত্যায় জড়িত সেই ‘কালপ্রিট’ কর্মকর্তাদের আইনের আওতায় না আনায় হতাশ শহিদপরিবারের সদস্যরা।
শহিদপরিবারের সদস্যরা গণমাধ্যমকে বলেছেন, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের এজেন্ডা বাস্তবায়নকারী ‘পুলিশ লীগের’ জড়িত কর্মকর্তা ও সদস্যদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে। এখনই গ্রেফতার করা না হলে বাকিরাও আত্মগোপন বা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবে। চাকরিতে বহাল থাকলে জুলাই হত্যা মামলায় জড়িত অপরাধীদের রক্ষায় অপচেষ্টা চালাবে তারা। এ অবস্থায় গণহত্যায় ‘হুকুমদাতা’ ও ‘সরাসরি জড়িত’ পুলিশ কর্মকর্তাসহ জড়িত সদস্যদের দ্রুত গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান তারা।
চাঁনখারপুল কিলিংয়ে জড়িত পুলিশকে গ্রেফতার ও বিচারের মুখোমুখি না করায় শহিদ আনাসের বাবা শাহরিয়ার খান পলাশ গণমাধ্যমকে বলেন, হত্যা মিশনে অংশ নেওয়া ও হুকুম দেওয়া আসামিরা পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেলে কিংবা গ্রেফতারে বিলম্ব হলে ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হবে। যেখানে প্রকাশ্যে গুলি করার ভিডিও রয়েছে, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী আছে, সেখানে টালবাহানা করার কারণ বোধগম্য নয়। জড়িতদের দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত করা না হলে শহিদ ও আহতদের পরিবারের সঙ্গে বেইমানি করা হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
পুলিশের গুলিতে শহিদ যারা: ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার রক্তের ওপর দিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায় স্বৈরাচার শেখ হাসিনা। তার পলায়নের বিষয়টি জানার পরও সুবিধাভোগী খুনি পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যদের তাণ্ডব থামেনি চাঁনখারপুলে। ওইদিন দুপুরের দিকে এডিসি আখতারের নির্দেশে গুলি চালানো হয় নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর। এতে স্কুলছাত্র আনাসসহ ঘটনাস্থলেই শহিদ হন সাতজন। গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে তাদের মধ্যে ৬ জনের বিস্তারিত পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হলেন পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ার শাহরিয়ার খান পলাশের ছেলে শাহরিয়ার খান আনাস, একই এলাকার শেখ জামাল হাসানের ছেলে শেখ মেহেদী হাসান জুনায়েদ, বংশালের ইউসুফ মিয়ার ছেলে মো. ইয়াকুব, একই এলাকার ফারুক আহামেদের ছেলে ইয়াসিন আহমেদ রাজ, চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার নুরুল হকের ছেলে মো. ইসমামুল হক এবং ঝালকাঠির মো. জাহাঙ্গীর হোসেনের ছেলে রাকিব হাওলাদার। অন্য একজনের পরিচয় কেউ নিশ্চিত করতে পারেনি।
হত্যায় জড়িত পুলিশ: জোন বা অঞ্চল হিসাবে চাঁনখারপুল এলাকা পুলিশের রমনা ও লালবাগ বিভাগের আওতাধীন। আন্দোলনের কেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও শহিদ মিনারমুখী হওয়ায় চাঁনখারপুলের একাংশসহ বেশির ভাগ এলাকা শাহবাগ থানার অধীন। ৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের সময় রমনা বিভাগে পুলিশের ডিসি (ক্রাইম) মো. আশরাফুল ইসলাম, রমনা জোনাল টিমের এডিসি শাহ আলম মো. আখতারুল ইসলাম, এসি মো. ইমরুল দায়িত্বে ছিল। এছাড়া রমনা বিভাগের আওতাধীন নিউমার্কেট জোনাল টিমের এডিসি হাফিজ আল আসাদ, এসি রেফাতুল ইসলাম এবং ধানমন্ডি জোনাল টিমের এডিসির দায়িত্বে ছিল মো. ইহসানুল ফিরদাউস, শাহবাগ থানার ওসি মোস্তাজিরুর রহমান ও পরিদর্শক (অপরাশেন) ছিল আরশাদ হোসেন।
একই সময়ে রমনা গোয়েন্দা বিভাগে ডিসি (ডিবি) মো. হুমায়ুন কবীর, এডিসি (অ্যাডমিন) মো. আজহারুল ইসলাম মুকুল, রমনা জোনাল টিমের এডিসি মিশু বিশ্বাস, এসি জাবেদ ইকবাল প্রীতম ও ধানমন্ডি জোনাল টিমের এডিসি ছিল মো. ফজলে এলাহী। এছাড়া অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও মাদক নিয়ন্ত্রণ টিমের এডিসি ছিল নাজিয়া ইসলাম।
সেই কর্মকর্তারা কে কোথায়: রমনার ডিসি আশরাফুল ইসলাম জুলাই হত্যা মামলার আসামি। সে বর্তমানে রংপুর রেঞ্জ অফিসে সংযুক্ত আছে। ৫ আগস্টের পর এডিসি আখতারকে সিলেটের ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারে বদলি করা হয়। সম্প্রতি গ্রেফতারের বিষয়টি টের পেয়ে কর্মস্থল থেকে পালিয়েছে সে। অন্যদের কেউ এপিবিএনে, কেউ কক্সবাজারের উখিয়ায় (এপিবিএন), কেউ গাজীপুরে শিল্প পুলিশে কর্মরত আছে। শাহবাগ থানার সাবেক ওসি মোস্তাজিরুর রহমান বর্তমানে বরিশালে ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারে কর্মরত আছে। একইভাবে ডিবির কর্মকর্তারাও বিভিন্ন জেলায় কর্মরত আছে। রমনায় জুলাই হত্যা মামলার অন্য আসামিদের মধ্যে রয়েছে ডিবির ডিসি হুমায়ুন কবীর, এডিসি ফজলে এলাহী, এসি জাবেদ ইকবাল প্রীতম ও এসি রেফাতুল। এর মধ্যে জাবেদ ইকবাল ট্রাইব্যুনালের একটি মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছে। বাকিরা পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে কর্মরত আছে।
কারাগারে এপিবিএন কনস্টেবল সুজন : উত্তরা থেকে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন-১৩) সদস্য কনস্টেবল মো. সুজন হোসেনকে ৫ আগস্ট হত্যা মিশনে চাঁনখারপুলে পাঠানো হয়। ঘটনার দিন তাকে নানা ভঙ্গিমায় গুলি চালাতে দেখা যায়। পলাতক এডিসি আখতার হোসেন পাশে থেকে তাকে নির্দেশনা দেয়। সাতজনকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় শাহবাগ থানার একটি মামলায় সুজন গ্রেফতার হয়। পরে ট্রাইব্যুনালের একটি মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। বর্তমানে কারাগারে আছে সুজন।
তথ্যসূত্র:
১. ‘হত্যা মিশনে’ জড়িত পুলিশের মধ্যে আসামি ৯৫২, গ্রেফতার মাত্র ২৮
– https://tinyurl.com/vpbevt28