খুলনা-মংলা রেলপথের প্রকল্প : সাড়ে ৯ বছরেও লাইন এবং সিগন্যাল নির্মাণ শুরু হয়নি

0
510
খুলনা-মংলা রেলপথের প্রকল্প : সাড়ে ৯ বছরেও লাইন এবং সিগন্যাল নির্মাণ শুরু হয়নি

একটি প্রকল্প যেখানে তিন বছরে শেষ করার কথা সেটা সাড়ে ৯ বছর ধরে চলছে। তাও আবার মূল কাজ রেলপথ বা ট্র্যাক নির্মাণ ও সিগন্যালের কাজ এখনো শুরুই করা হয়নি। ছয় বছর পর প্রকল্পের ডিজাইনসহ বিভিন্ন অঙ্গে পরিবর্তন আনা হয়। এখন প্রকল্পের বাস্তবায়ন খরচ ১২০.৮৫ শতাংশ বা ২ হাজার ৮০ কোটি ২১ লাখ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। ছয় বছর পর মাঠ পর্যায়ের কাজ শুরু করা হয়। ২০২০ সালেও প্রকল্পটি সমাপ্ত হবে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। পরিকল্পনা কমিশন বলছে, আগে থেকে মাটি পরীক্ষা করে প্রকল্পের এলাকা নির্ধারণ এবং সে অনুযায়ী ডিজাইন প্রণয়ন করা হলে প্রকল্পে এতটা সময়ক্ষেপণ হতো না। পাশাপাশি ঋণদাতার কাছেও দেশের ভাবমর্যাদা নষ্ট হতো না।

রেলওয়ের প্রস্তাবনার তথ্য থেকে জানা গেছে, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও দক্ষিণ অঞ্চলকে ঢাকার সাথে সরাসরি সংযোগ করার জন্য পদ্মা নদীর ওপর একটি বহুমুখী সেতু নির্মাণকাজ চলমান আছে। এই সেতুতে ব্রডগেজ রেলওয়ের সুবিধা বিদ্যমান। পদ্মা সেতু বাংলাদেশের জাতীয় যোগাযোগ অবকাঠামোর ক্ষেত্রে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে। এতে প্রথম পর্যায়ে পদ্মা রেলওয়ে সংযোগ ভাঙ্গা পর্যন্ত হবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে যশোর পর্যন্ত রেলপথ বর্ধিত হবে। চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর থেকে চাপ কমানোর জন্য মংলা বন্দরকে রেলওয়ে নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত করা প্রয়োজন। এতে খুলনা-মংলা রেলপথ প্রকল্পের মাধ্যমে আঞ্চলিক যোগাযোগ স্থাপন হবে। ভারত, নেপাল, ভুটান এই রেলপথের মাধ্যমে মংলা বন্দর ব্যবহার করে তাদের আমদানি-রফতানি বাণিজ্য করতে পারবে। বতর্মানে ফুলতলা স্টেশন থেকে মংলা বন্দর পর্যন্ত প্রায় ৬৪ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেলপথ বিদ্যমান।

প্রকল্পের কার্যক্রম :
প্রস্তাবনা থেকে জানা যায়, ভূমি অধিগ্রহণ, খুলনা থেকে মংলা বন্দর পর্যন্ত ৬৪ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার মেইন লাইন নির্মাণ, ২১ দশমিক ১১ কিলোমিটার লুপ লাইন নির্মাণ, ৮টি রেলওয়ে স্টেশন, ৩১টি মেজর ও মাইনর ব্রিজ, ১১২টি কালভার্ট, রূপসা নদীর ওপর ৭১৬.৮০ মিটার ব্রিজ নির্মাণ, রূপসা সেতুর দুই প্রান্তে ভায়াডাক্ট নির্মাণ।

প্রাক্কলিত ব্যয় ও সময় বাড়ছে :
প্রস্তাবনা থেকে জানা গেছে, ২০১০ সালের ১২ জানুয়ারি একটি যৌথ বিবৃতি ইস্যু করা হয়। এ ছাড়া সার্ক মাল্টি মোডাল ট্রান্সপোর্ট স্ট্যাডি থেকে মংলা পোর্টের মাধ্যমে নেপাল, ভুটান মালামাল আমদানি বা রফতানিবাণিজ্য করতে পারে বলে প্রস্তাব করা হয়। তারই ফলে ২০১০ সালের ৩১ ডিসেম্বর খুলনা-মংলা বন্দর রেলপথ নির্মাণসহ সম্ভাব্যতা যাচাই নামে একটি প্রকল্প ১ হাজার ৭২১ কোটি টাকা ব্যয়ে অনুমোদন দেয়া হয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায়। ২০১৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর এই প্রকল্পটি সমাপ্ত হওয়ার কথা। প্রকল্পটি ভারত সরকারের (এলওসি) ঋণের অর্থে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। অনুমোদিত ব্যয়ের মধ্যে ভারতীয় ঋণ এক হাজার ২০২ কোটি ৩১ লাখ ১৪ হাজার টাকা ও বাংলাদেশ সরকারের ৫১৯ কোটি টাকা। এরপর ব্যয় ১২০ দশমিক ৮৫ শতাংশ বাড়িয়ে ৩ হাজার ৮০১ কোটি ৬১ লাখ টাকা করা হয়। প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর বাড়িয়ে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়। কিন্তু তাতেও কোনো অগ্রগতি নেই।

প্রাথমিক পর্যায়ে এলাইনমেন্ট চূড়ান্তকরণে বিলম্ব হওয়ায় ফাইনাল সার্ভে, এলএ প্লান এবং ডিটেইল ডিজাইন করতে বিলম্ব হয়। এপ্রোচ রোড ছাড়া ভূমি অধিগ্রহণ কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি জেলা প্রশাসক সর্বশেষ ভূমি আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করেন। এরপর মেয়াদ বাড়িয়ে ২০১৮ সালের জুন, তারপর ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। কিন্তু ২০২০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বাস্তবে কাজ হয়েছে ৬৩ শতাংশ। অথচ এই সময়ে ৮৭ শতাংশ কাজ শেষ করার কথা ছিল। আর অর্থ খরচ হয়েছে ৬৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ।

আইএমইডির প্রতিবেদনে এই তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। নতুন করে ব্যয় ৩ হাজার ৮০১ কোটি ৬১ লাখ টাকা হওয়ায়, সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে এক হাজার ৪৩০ কোটি ২৬ লাখ টাকা এবং ভারতীয় ঋণ থেকে দুই হাজার ৩৭১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা জোগান দেয়া হবে।

কম অগ্রগতির কারণ :
প্রকল্পের অগ্রগতি কম হওয়ার কারণ হিসেবে আইএমইডি বলছে, জমি অধিগ্রহণে দেরি, কাজের মাঝামাঝি এসে পরামর্শক পরিবর্তন করতে হয়েছে। এক্ষেত্রে ‘সিইজি-নিপ্পন কই জেভি’ থেকে স্টপ কনসালট্যান্ট দায়িত্ব গ্রহণ করে। কিন্তু কিছু জটিল নন-টেন্ডার আইটেম যেমন অত্যধিক লুজ সয়েল থাকায় ট্রিটমেন্ট, পাইল বারবার ফেল করায় ও বেস গ্রাউন্ডিং, অধিক সংখ্যক আনাড়ি সাব-কন্ট্রাক্টর নিয়োগ এসব কারণে প্রকল্পের কাজ বারবার পিছিয়েছে।

বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ২০১৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর মাঠ পর্যায়ের কাজ শুরু হয়। কাজ শুরু করতে গিয়ে দেখা যায় যে, মাটির গুণাগুণ আশানুরূপ নয়। ফলে নতুনভাবে ডিজাইন রিভিউ করে বিশেষজ্ঞ মতামত নিয়ে গ্রাউন্ডিংসহ পাইলিং কাজ করতে হয়েছে। এতে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে অতিরিক্ত সময় প্রয়োজন। বিষয়টি ইআরডি ও ভারতীয় হাইকমিশনকে অবহিত করা হয়েছে। মেয়াদ ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত অনুমোদিত ছিল। দুটি প্যাকেজের চুক্তিপত্রের মেয়াদ আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। তবে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত বর্ধিত করা প্রয়োজন। এখনো ট্র্যাক নির্মাণ কাজের চুক্তিপত্রের বিপরীতে দাখিলকৃত প্রথম ভেরিয়েশন প্রস্তাব অনুমোদিত হয়নি। ফলে কাজের অগ্রগতি ব্যাহত হচ্ছে।

আইএমইডির পর্যবেক্ষণ হলো, এই প্রকল্পে রেললাইনের কাজ পিছিয়ে গেছে। এ পর্যন্ত কাজ শেষ হয়েছে মাত্র ৫৪ শতাংশ। এখানে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে যথাযথ জনবল নিয়োগ করে টার্গেট অনুযায়ী ঠিকাদারের কাছ থেকে কাজ বুঝে নেয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রকল্পে ব্যয় নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ রেলওয়ের সার্বক্ষণিক মনিটরিং রাখতে হবে। প্রকল্প স্টিয়ারিং কমিটি ও প্রজেক্ট ইম্পিলিমেনটেশন কমিটির সব সভা সময় মতো করতে হবে। প্রকল্পে কর্মরত বিদেশী জনবলের ভিসার মেয়াদ ন্যূনতম এক বছর থাকা এবং পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের জনবলের বিল পরিশোধ প্রক্রিয়াটি নিয়মিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। চুক্তিপত্রের শর্ত অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঠিকাদারের আইপিসি পরিশোধ করা দরকার। নয়া দিগন্ত

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি-অনিয়মের গভীরে কারা?
পরবর্তী নিবন্ধউদ্বোধনের আগেই শেষ নবনির্মিত সড়ক