বাংলাদেশ গ্যাসফিল্ড কোম্পানি লিমিটেডের (বিজিএফসিএল) তিতাস লোকেশনে ৭টি ওয়েলহেড কম্প্রেসার স্থাপন প্রকল্পে বড় ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।
প্রায় ৯১০ কোটি টাকার এ প্রকল্পের শুরুতেই সরকারি প্রভাবশালী চক্র দুর্নীতির ফাঁদ পেতেছে। জাল-জালিয়াতি করে এমন প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া হয়েছে যার সক্ষমতা তো দূরের কথা, অফিশিয়াল অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। খোদ বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি বিভাগের একজন শীর্ষ কর্মকর্তার যোগসাজশে চলছে লুটপাটের মহোৎসব।
অভিযুক্ত কোম্পানির সঙ্গে জ্বালানি বিভাগের ওই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার এক চাচার গোপন মালিকানার সম্পর্ক রয়েছে। যিনি এক সময় তিতাস গ্যাস কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার ও পরবর্তী সময়ে পেট্রোবাংলার পরিচালক ছিলেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ গ্যাসফিল্ডে ঠিকাদারি করছেন।
প্রসঙ্গত, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিতর্কিত কোম্পানির নাম টেকনোস্টিম এনার্জি। যাচাই-বাছাই না করেই তড়িঘড়ি করে বিজিএফসিএল টেকনোস্টিম এনার্জিকে নোয়া (নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড) ইস্যু করেছে।
কিন্তু নোয়া ইস্যুর ২৮ দিনের মধ্যে কোম্পানিটি চুক্তি করতে পারেনি। জমা দিতে পারেনি দরপত্রের ১০ শতাংশ পারফরম্যান্স গ্যারান্টির (পিজি) টাকাও। কোম্পানির স্থানীয় এজেন্ট মজুমদার এন্টারপ্রাইজের প্রতারণার কারণে দরপত্রের সঙ্গে জমা দেয়া সাড়ে ১২ কোটি টাকার বিডবন্ডটিও মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যায়।
কার্যাদেশ দেয়ার আগমুহূর্তে কোম্পানিটি নিয়ে এমন বিব্রতকর অবস্থার মুখোমুখি হয়ে বড় ধরনের বিপাকে পড়েছে বিজিএফসিএল। বারবার চিঠি দিয়েও কোনো সাড়া না পাওয়ায় বিডবন্ডের সাড়ে ১২ কোটি টাকা বাজেয়াপ্ত করতে গিয়েও দেখা যায় সেটির মেয়াদ নেই।
কিন্তু তারপরও টেকনোস্টিম এনার্জিকে ব্ল্যাকলিস্ট করেনি। উল্টো এখন আবার ওই কোম্পানিকেই ভিন্ন উপায়ে কার্যাদেশ দেয়ার পাঁয়তারা চলছে। পাইপলাইনার্স নামে তৃতীয় একটি কোম্পানির কাছ থেকে পারফরম্যান্স সিকিউিরিটি (পিজি) নিয়ে অবৈধভাবে ওই কোম্পানিকেই কার্যাদেশ দেয়া হচ্ছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশ গ্যাসফিল্ডের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান জ্বালানি বিভাগের সচিব আবু হেনা রহমাতুল মুনিম। বিশ্লেষকরা বলছেন, এরপরও কীভাবে এরকম একটি কোম্পানিকে এত বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য নির্বাচন করা হল- সেটি রহস্যজনক। এ নিয়ে জ্বালানি সচিবের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি এ প্রতিবেদকের ফোন ধরেননি।
বিজিএফসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তৌফিকুর রহমান তপু যুগান্তরকে বলেন, ভাই একটু সমস্যা হয়ে গেছে। বিপদে পড়ে গেছি। প্লিজ এখন কিছু লেখবেন না। চেষ্টা করছি প্রবলেমটি সমাধা করতে। একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কথা দিলাম, কমিটি যাচাই-বাছাই করে রিপোর্ট দিলে আমি আপনাকে ফাইল খুলে সব দেখাব।
বাস্তবে সর্বনিম্ন দরদাতা টেকনোস্টিম এনার্জির কোনো অস্তিত্ব নেই, তাদের আর্থিক সচ্ছলতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আপনি তো সব জানেন, আমার মুখ দিয়ে বলানোর চেষ্টা করছেন কেন? আমি বলতে পারব না। তাছাড়া এটা জানারও কোনো উপায় নেই। ওয়েবসাইট ছাড়া সরেজমিন গিয়ে দেখারও কোনো নিয়ম নেই।
যেহেতু পিপিআর অনুযায়ী যথাসময়ে সর্বনিম্ন দরদাতা পিজি জমা দিতে পারেনি, এবং বিডবন্ডের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে তাই দরপত্র কি বাতিল করা হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শুনেছি সর্বনিম্ন দরদাতা তৃতীয় একটি কোম্পানির মাধ্যমে পিজি জমা দিয়েছে, বিডবন্ডের মেয়াদও আরও এক মাস বাড়ানো হয়েছে। কাজেই এখন পরিচালনা পর্ষদ সব কিছু বুঝেশুনে সিদ্ধান্ত নেবে। উল্লেখ্য, চলতি সপ্তাহের শেষদিকে এ নিয়ে পরিচালনা পর্ষদের বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।
বিজিএফসিএল সূত্রে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এ কোম্পানিটির অস্তিত্ব নিয়ে সম্প্রতি পেট্রোবাংলায় পিপিসি কমিটির এক বৈঠকে প্রশ্ন ওঠায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
অভিযোগে বলা হয়েছে- কোম্পানিটির লেটারহেড প্যাডে যুক্তরাষ্ট্রের যে ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে সেখানে এর কোনো অস্তিত্ব নেই। ২০১৯ সালের প্রথমদিকে অর্থাৎ টেন্ডার আহ্বানের পরে কোম্পানিটির ওয়েবসাইট খোলা হয়েছে। দরপত্রে অংশগ্রহণের জন্য তারা যেসব অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেছে বাস্তবে কোম্পানিটি সেরকম কোনো কাজই করেনি।
অভিযোগ আছে, জ্বালানি বিভাগের ওই শীর্ষ কর্মকর্তার চাচাই মূলত একটি নামসর্বস্ব কোম্পানি খুলে এই দরপত্রে অংশ নিয়েছিলেন। তার সঙ্গে লোকাল এজেন্ট হিসেবে রয়েছে মজুমদার এন্টারপ্রাইজ। টার্গেট ছিল যেনতেন করে কার্যাদেশ নিয়ে ‘কাগজ’টি তৃতীয় পক্ষের কাছে মোটা অঙ্কের অর্থে বিক্রি করে দেয়া।
বিজিএফসিএলের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, এই দরপত্রের বিরুদ্ধে পরিচালনা পর্ষদের যে দুই সদস্য সব সময় বোর্ড মিটিংয়ে সরব থাকতেন রহস্যজনক কারণে তাদের কেউ এখন বোর্ডে নেই।
জানা গেছে, পাইপলাইনার্স লিমিটেড নামের ওই কোম্পানিটি টেকনোস্টিমের পক্ষে এনসিসি ব্যাংকের মাধ্যমে পিজির গ্যারান্টার হয়েছে। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা কোনোভাবেই বৈধ নয়। এটা বড় ধরনের দুর্নীতির শামিল।
জানা গেছে, তিতাস লোকেশন ‘এ’-তে প্রতিদিন ৬০ মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন মোট ৭টি ওয়েলহেড কম্প্রেসার স্থাপনের লক্ষ্যে ২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়। কারণ, এই ৭টি কূপে গ্যাসের চাপ কমে গিয়েছিল। কম্প্রেসার বসানো হলে কূপগুলো থেকে আগের মতো গ্যাস উৎপাদন সম্ভব হবে। প্রকল্পটি একনেক সভায় অনুমোদন হয় ২০১৬ সালে। দরপত্রে অংশগ্রহণকারী কোম্পানি তিতাসের ৭টি গ্যাসকূপের ওয়েলহেড কম্প্রেসার ডিজাইন তৈরি, ইঞ্জিনিয়ারিং, ক্রয়, সরবরাহ, স্থাপন, টেস্টিং, কমিশনিং, অপারেশন এবং মেইনটেইনেন্সের কাজ করবে। ২০১৯ সালের ৩ মার্চ দরপত্র উন্মুক্ত করা হয়। মোট ৭টি কোম্পানি এতে অংশ নিলেও দুটি কোম্পানি কারিগরি ও আর্থিকভাবে রেসপনসিভ হয়। কোম্পানি দুটি হল- সিঙ্গাপুরভিত্তিক এন্টার ইঞ্জিনিয়ারিং প্রাইভেট লিমিটেড এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক টেকনোস্টিম এনার্জি লিমিটেড। গত ৯ সেপ্টেম্বর আর্থিক মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বিজিএফসিএল বোর্ডে অনুমোদিত হয়। এরপরই ১২ সেপ্টেম্বর তড়িঘড়ি করে বিজিএমসিএল সর্বনিম্ন দরদাতা টেকনোস্টিম এনার্জিকে নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড (নোয়া) প্রদান করে। ১৭ সেপ্টেম্বর ঠিকাদার কোম্পানি নোয়া-এর বিপরীতে ইকসেপটেন্স লেটার পাঠায় বিজিএফসিএলকে।
নিয়ম অনুযায়ী চুক্তি সম্পাদনের নোটিশ (নোয়া) ইস্যুর ২৮ দিনের মধ্যে দরদাতা কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করতে হয়। কিন্তু নির্ধারিত সময়সীমা ১০ অক্টোবর শেষ হয়ে গেলেও সর্বনিম্ন দরদাতা টেকনোস্টিম এনার্জি বিজিএফসিএলের সঙ্গে কোনো ধরনের চুক্তি সম্পাদন করেনি। বারবার চিঠি ও তাগাদা দিলেও তারা চুক্তি করেনি। এমনকি কার্যসম্পাদন জামানত (পাফরম্যান্স সিকিউরিটি) পর্যন্ত দাখিল করেনি। বিজিএফসিএল সূত্র জানায়, তারা এ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ওই কোম্পানির সঙ্গে নানাভাবে চেষ্টা করেও যোগাযোগ করতে পারেনি।
একপর্যায়ে বিজিএফসিএল দরপত্রের সঙ্গে দেয়া জামানতের (বিড সিকিউরিটি) ১২ কোটি ৫০ লাখ টাকা কর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়। এই বিড সিকিউরিটির মেয়াদ ছিল ২৬ অক্টোবর পর্যন্ত। ২৪ অক্টোবর প্রকল্পের পিডি গুলশানের প্রিমিয়ার ব্যাংককে চিঠি দিয়ে এই টাকা বিজিএফসিএলের ফান্ডে নগদায়ন করার জন্য জানান। কিন্তু স্থানীয় এজেন্ট মজুমদার এন্টারপ্রাইজ, ব্যাংক ও বিজিএফসিএলের সঙ্গে যোগসাজশে এই চিঠি ৩০ অক্টোবর ব্যাংকে পৌঁছে। ততক্ষণে বিড সিকিউরিটির মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। ফলে মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার কারণ উল্লেখ করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বিড সিকিউরিটি আদায় করা সম্ভব নয় বলে বিজিএফসিএলকে লিখিতভাবে জানিয়ে দেয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকল্প পরিচালকের উচিত ছিল ১০ অক্টোবরের পরদিনই বিড সিকিউরিটি বাতিল করে বিজিএফসিএলের অনুকূলে ব্যাংকড্রাফটি নগদায়ন করা। কিন্তু তিনি তা করেননি, এমনকি নভেম্বরের শুরুতে পেট্রোবাংলায় অনুষ্ঠিত মাসিক বাস্তবায়ন অগ্রগতি প্রতিবেদনে তথ্য গোপন করে প্রকল্প সম্পর্কে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য দিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে মজুমদার এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী জসিম উদ্দিন মজুমদারের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি। ব্যস্ততার কথা বলে পরে কথা বলবেন বলে টেলিফোন রেখে দেন। তাকে এ নিয়ে মেইল করা হলেও তিনি মেইলের কোনো উত্তর দেননি। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি টেকনোস্টিম এনার্জির কর্মকর্তা রিকার্ডো সিয়ন্তিকে ২০ ডিসেম্বর মেইল করা হলে তিনি মেইলের উত্তর দেননি।
নিয়ম অনুযায়ী বিড সিকিউরিটি আদায় করতে না পারায় ওই কোম্পানিকে (টেকনোস্টিম এনার্জি) ব্ল্যাকলিস্ট করে তাদের নোয়া বাতিল করা। এমনকি জালিয়াতির আশ্রয় নেয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা। কিন্তু স্বার্থান্বেষী মহল তা না করে এখন অন্য একটি কোম্পানির মাধ্যমে পিজি নিয়ে এবং গোপনে বিডবন্ডের মেয়াদ বাড়িয়ে সেই প্রতারক কোম্পানিকেই কার্যাদেশ দেয়ার পাঁয়তারা করছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি কোনো কারণে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো কিংবা রিটেন্ডার আহ্বান করা হয়, তাহলে এর ব্যয় ১৫শ’ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। কারণ ইতিমধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ৩ বছর পার হয়ে গেছে।
এখন নতুন করে টেন্ডার আহ্বান করলে প্রতিটি ওয়েলহেড কম্প্রেসারের ক্ষমতা ৬০ মিলিয়ন ঘনফুট থেকে বাড়িয়ে কমপক্ষে ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট করতে হবে। এতে একদিকে প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যাবে, অপরদিকে গ্যাস উত্তোলনের পরিমাণও কমবে। এর ফলে সরকার বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বে, এবং ভোক্তারা বঞ্চিত হবে গ্যাস প্রাপ্তিতে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক আবুল জাহিদ যুগান্তরকে বলেন, নির্ধারিত সময় পার হওয়ায় প্রকল্পটি নিয়ে একটু প্রবলেম হয়ে গেছে। যেহেতু এটি এডিবির একটি প্রকল্প তাই আমরা তাদের পুরো বিষয়টি জানিয়ে চিঠি লিখেছি। তিনি বলেন, ২৮ দিন পার হওয়ার পর টেকনোস্টিম এনার্জির কাছ থেকে পিজি পেয়েছেন।
তবে শুনেছি, ওই পিজি প্রদানের বিহাইন্ড দ্য সিনে পাইপলাইনার্স নামে দেশীয় একটি কোম্পানি রয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমাদের দরকার পিজির। পেছনে কে আছে সেটা দেখার দরকার নেই।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দরপত্রে অংশগ্রহণকারী কোম্পানির অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানার জন্য তিনি মেইলে যোগাযোগ করেন। কেউ উত্তর দেয়, কেউ দেয় না। জানার জন্য একমাত্র ওয়েবসাইটই মূল ভরসা। এ কারণে টেকনোস্টিম সম্পর্কেও তিনি সবকিছু যাচাই-বাছাই করতে পারেননি।