বৈশ্বিক পর্যায়ে এ মুহূর্তে যে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটছে, নিঃসন্দেহে সেটার কেন্দ্রে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র-চীন উত্তেজনা। চীনের বিরুদ্ধে একটা ‘নতুন শীতল যুদ্ধ’ সৃষ্টি করার জন্য সক্রিয়ভাবে চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র। দিন দিন এটা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, যুক্তরাষ্ট্র এখনও সেই দুই-মেরু বিশ্ব মানসিকতার মধ্যে আটকে আছে, বর্তমান বিশ্বে যেটার প্রাসঙ্গিকতা বহু আগেই শেষ হয়ে গেছে। এর কারণ হলো, সোভিয়েত ইউনিয়নকে পশ্চিমা বিশ্বে যেভাবে মারাত্মক হুমকি হিসেবে দেখা হতো, চীনকে সেভাবে দেখা হয় না।
যেটা দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের মতো ইউরোপ চীনের ব্যাপারে তাদের দরজা বন্ধ করা বা তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার ব্যাপারে আগ্রহী নয়। আবার একই সাথে বেল্ট অ্যাণ্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) মাধ্যমে চীন সেই সব দেশ ও অঞ্চলে শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তুলেছে, যে সব দেশে চীনের বিরুদ্ধে ‘নতুন শীতল যুদ্ধ’ শুরু করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।
এই দেশগুলোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পদাঙ্ক অনুসরণ এবং চীন থেকে ‘বিচ্ছিন্ন’ হওয়ার অর্থ হলো নতুন সিল্ক রোড এবং এর সাথে জড়িত বাণিজ্য ও উন্নয়নের সম্ভাবনা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার মতো। কিন্তু সেখানে কোন বিকল্প বাণিজ্য রুট উপস্থাপনের কিছু নেই যুক্তরাষ্ট্রের।
যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব রাজনীতিকে কোন দিকে নিতে চাচ্ছে, ক্যালিফোর্নিয়া থেকে মাইক পম্পেওর দেয়া সাম্প্রতিক বক্তৃতায় সেটা উঠে এসেছে। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্র দেশগুলোকে চীনের মোকাবেলা ও তাদেরকে পিছনে সরিয়ে দেয়ার জন্য ‘আরও সৃজনশীল ও আগ্রাসী’ কৌশল নিতে হবে। অন্যভাবে বললে, ‘নতুন শীতল যুদ্ধের’ অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো তারা চীনকে ‘নিয়ন্ত্রণ’ করতে চায় না; তারা ইউরোপ, আফ্রিকা এবং এশিয়া ও প্রশান্ত এলাকা থেকে চীনকে জোর করে বের করে দিতে চায় যাতে সেই সব জায়গায় মার্কিন আধিপত্য বজায় থাকে।
ইউরোপ আর এশিয়ার বাস্তবতায় অবশ্য দেখা যাচ্ছে যে, চীনের বিরুদ্ধে ‘বৈশ্বিক জোট’ গড়া এবং চীন থেকে ‘বিচ্ছিন্ন’ হওয়ার মার্কিন আহ্বানে খুব একটা সাড়া মিলছে না। অন্যদিকে, আঞ্চলিক দেশগুলো চীনের সাথে সহযোগিতা এবং ‘গঠনমূলক বিনিময়’ বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন মেকানিজম গড়ে তোলার চেষ্টা করছে।
এটা বিশেষভাবে দৃশ্যমান হয়েছে যখন আসিয়ান – যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ঐতিহাসিকভাবে সক্রিয় ভূমিকা রেখে এসেছে – এখন পর্যন্ত দক্ষিণ চীন সাগরে নৌ চলাচলের স্বাধীনতার জন্য চীনের সাথে একটা দর কষাকষির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আসিয়ান কোন ধরনের মোকাবেলা বা পৃথক হওয়ার মানসিকতায় নেই এবং এর প্রধান কারণ হলো যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়া নীতির ব্যাপারে তাদের আর বিশ্বাস নেই। গত বছর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আসিয়ানের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন এড়িয়ে গেছেন এবং সেটা এই অঞ্চলের নেতাদের স্মৃতিতে এখনও দগদগে রয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যেভাবে ‘আমেরিকা প্রথম’ নীতির অধীনে যুক্তরাষ্ট্রের ‘এশিয়া কেন্দ্র’ এবং প্রায় ৪০টি দেশের সাথে সম্পৃক্ত বাণিজ্য চুক্তিকে হত্যা করেছেন, সেটা এই দেশগুলোকে চীনের সাথে বিকল্প পথে যোগাযোগ বাড়ানোর জন্য বাধ্য করেছে।
এটা থেকেই বোঝা যায় কেন যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে বিবৃতি দেয়ার পরও সেটার প্রতিক্রিয়ায় পাথরের নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে যে, “এসসিএসকে নিজেদের নৌ সাম্রাজ্য হিসেবে গণ্য করতে চীনকে অনুমতি দেবে না বিশ্ব”। মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিশামুদ্দিন হোসেন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী ভাবকে নিভিয়ে দিয়ে বলেছেন যে, এসসিএসে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যে “বিভিন্ন দেশকে সামরিক তৎপরতা থেকে বিরত থাকতে হবে”।
তিনি আরও বলেন, “আমাদেরকে সামরিক শক্তি প্রদর্শন বন্ধ করতে হবে, কারণ সমস্যা সমাধানে এটা কোন সাহায্য করবে না, এবং এই ব্যাপারে আসিয়ান দেশগুলোকে একমত হতে হবে…”।
এটা স্পষ্ট যে, আসিয়ান চীনের সাথে কোন ধরনের সঙ্ঘাতে যেতে চায় না এবং ‘দ্বি-মেরুর’ কোন রাজনীতিতে কার্যকরভাবে যুক্ত হওয়ারও আগ্রহ তাদের নেই। এর একটা বড় কারণ হলো অনেকগুলো আসিয়ান দেশেরই চীনের সাথে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে এবং চীনের বিরুদ্ধে অপ্রয়োজনীয় আগ্রাসী অবস্থান নিলে সেটা তাদের নিজেদের অর্থনৈতিক উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
দক্ষিণ এশিয়ার কথা বললে, আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্থান যেখানে আসন্ন, যেখানে সিপিইসির গতি বাড়ছে এবং চীনের বিআরআই আরও বিস্তৃত হয়ে ইরানে প্রবেশ করেছে, সেখানে আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক মানচিত্র সোভিয়েত ইউনিয়ন বনাম যুক্তরাষ্ট্রের শীতল যুদ্ধকালীন সময়ের মতো নয়, এবং চীনের বিরুদ্ধে একটা দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধাবস্থা ধরে রাখার মতো সেখানেই মোটেই বিরাজ করছে না।
যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে চলে যাচ্ছে বলে মধ্য এশিয়ার উন্নয়নে তাদের প্রভাবও কমে আসছে। ইউরেশিয়ায় সংযোগ বাড়ানোর জন্য রাশিয়ার নিজস্ব কর্মসূচি রয়েছে এবং ‘নতুন শীতল যুদ্ধ’কে সফল গল্পে রূপ দিতে হলে আমেরিকাকে রাশিয়ার কর্মসূচিকেও মোকাবেলা করতে হবে।
তবে, গুরুত্বপূর্ণ হলো যুক্তরাষ্ট্র এমন সময় তাদের ‘নতুন শীতল যুদ্ধ’ তৈরি করছে, যখন তারা ইউরেশিয়ার কেন্দ্রভূমি থেকে সরে যাচ্ছে। সে কারণে ‘নতুন শীতল যুদ্ধ’ যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি সামরিক উপস্থিতি নিশ্চিত করার সুযোগ দেবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়ার কারণে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে, দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের ‘শীতল যুদ্ধের ফ্রন্টটা’ ততটা সক্রিয় হবে না। তবে ইউরোপ ও এশিয়ার বেশ কিছু দেশ চীনের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক জোট গড়ার আহ্বানে সাড়া না দেয়ার পেছনে একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো তাদের অনেকেই এই আহ্বানকে ট্রাম্পের ব্যক্তিগত আহ্বান হিসেবে দেখছে এবং তারা বিশ্বাস করে যে, নির্বাচনে পরাজয়ের পর ট্রাম্প যখন হোয়াইট হাউজ ছাড়তে বাধ্য হবেন, তখন বৈশ্বিক কৌশলগত চেহারা বদলে যাবে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এরই মধ্যে নির্বাচনী জরিপে পিছিয়ে পড়েছেন। তার প্রতিপক্ষ জো বাইডেন ঘোষণা দিয়েছেন যে, চীনের সাথে মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধের তিনি ইতি টানবেন এবং চীনের সাথে তিনি উত্তেজনা বাড়াতে চান না বা একটা ‘শীতল যুদ্ধ’ তিনি তৈরি করতে চান না।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার একটা সম্ভাবনা নজরে পড়ছে যদিও ট্রাম্প এখনও ক্ষমতায় রয়েছেন। তাছাড়া মহামারী-পরবর্তী অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যে একটা ‘শীতল যুদ্ধ’ টিকিয়ে রাখাটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য যেমন কঠিন হবে, তেমনি এই দুই মেরুর ‘শীতল যুদ্ধের’ পক্ষে ক্ষুদ্র দেশগুলোকে চীনের বিরুদ্ধে একটা জোরালো নীতি গ্রহণ করানোটাও হবে খুবই কঠিন।
ইউরোপ এরই মধ্যে চীনের ব্যাপারে ক্রমাগত স্বাধীন পথে হাঁটছে এবং এমনকি ইরান প্রশ্নে তারা যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীতেও দাঁড়িয়েছে, এ অবস্থায় এটা সুস্পষ্ট যে, বিশ্ব ব্যবস্থা এরই মধ্যে বহুমেরুর হয়ে গেছে। সে কারণে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বকে জোর করে একটা দুই মেরুর রাজনীতিতে ঠেলে দেয়ার জন্য যে সুবিধাজনক পরিবেশ পেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, সেটা এখন আর তারা পাবে না। সাউথ এশিয়ান মনিটর