ইয়েমেন যুদ্ধ: একটু পেছন ফিরে দেখা

1
993

বৈশ্বিক ইসলামি প্রতিরোধ বাহিনী আল-কায়েদা ২০০০ সাল থেকে আরব উপদ্বীপে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। ২০০৪ সাল পর্যন্ত সৌদি আরব এবং ইয়েমেনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা লক্ষ্যবস্তুতে ধারাবাহিক আঘাত হানে দলটি। তবে সেসময়টাতে দলটির অনেক দায়িত্বশীল শহীদ এবং বন্দী হন, ফলে কাজ কিছুটা স্তিমিত হয়ে এসেছিল। কিন্তু ২০০৬ সালে শত্রুর চোখে ধুলো দিয়ে ইয়েমেনের রাজধানী সানার একটি কারাগার থেকে নিরাপদে বের হয়ে যেতে সক্ষম হন আল-কায়েদার ২৩ জন শীর্ষস্থানীয় মুজাহিদ। তাদের মাঝে অন্যতম হচ্ছেন শাইখ নাসির আল-উহায়শি এবং কাসিম আল-রিমী। মুক্ত বাতাসে শীর্ষ নেতাদের প্রত্যাবর্তনে আরব উপদ্বীপে দলটি পুনরায় সক্রিয় হয়ে উঠে।

মুক্ত হয়েই তারা প্রতিরোধ বাহিনীকে পুনর্গঠন এবং ইয়েমেনে শত্রু বাহিনীর লক্ষ্যবস্তুতে অভিযান চালানো শুরু করেন। এরপর জানুয়ারী ২০০৯ সালে তাঁরা আল-কায়েদা আরব উপদ্বীপের অধীনে “আনসারুশ শরিয়াহ্” নামে একটি নতুন প্রতিরোধ বাহিনী গঠনের ঘোষণা দেন। এর মধ্য দিয়ে ইয়েমেনে শত্রুদের বিরুদ্ধে পুরোদস্তুর যুদ্ধ শুরু করে আল-কায়েদা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মদদপুষ্ট হাদি বাহিনী এবং বিদ্রোহী শিয়া মিলিশিয়াদের বিরুদ্ধে চলে আল-কায়েদার এই অভিযান।

এর মধ্যে ২০১১ সালে দেশটিতে ক্ষমতালোভীদের মধ্যে গদি দখলের লড়াই শুরু হলে দেশে অরাজকতা ও চরম বিশৃঙ্খলা শুরু হয়। সেই সুযোগে শিয়া মিলিশিয়া গ্রুপগুলো সুন্নি অধ্যুষিত এলাকাগুলো দখল করতে শুরু করে। ফলে অনিরাপদ হয়ে পড়ে সুন্নি অধ্যুষিত এলাকা ও জনগণের জান-মালের নিরাপত্তা। এসময় জনগণের জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তাদের পাশে এসে দাঁড়ায় ইসলামি প্রতিরোধ বাহিনী আনসারুশ শরিয়াহ্। তাঁরা ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে সুন্নি অধ্যুষিত এলাকাগুলো নিরাপদ রাখতে সামরিক পদক্ষেপ নিতে শুরু করেন। এর ধারাবাহিকতায় আনসারুশ শরিয়াহ্’র মুজাহিদগণ হাদরামাউত, শাবওয়াহ এবং আবিয়ানের মতো গুরত্বপূর্ণ প্রদেশগুলো থেকে ক্ষমতালোভীদের হটিয়ে সেগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেন।

এদিকে ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে আলি আব্দুল্লাহ সালেহ ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হলে দেশটির ক্ষমতা দখল করে মার্কিন মদদপুষ্ট মানসুর হাদি। সে ক্ষমতায় এসেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষায় মনোনিবেশ করে। এই লক্ষ্যে সে আল-কায়েদা নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোতে আগ্রাসন শুরু করে। কিন্তু মার্কিনীদের খুশী করতে গিয়ে সে রাজধানীর নিরাপত্তার কথা বেমালুম ভুলে যায়। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে রাজধানী সানা দখল নেয় ইরান সমর্থিত হুতি শিয়ারা। আর ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে সানা থেকে পালাতে বাধ্য হয় আমেরিকার তাঁবেদার মানসুর হাদি।

মানসুর হাদি যখন সুন্নি মুসলিমদেরকে কট্টর সুন্নি বিদ্বেষী হুতি শিয়াদের হাতে ছেড়ে পালিয়ে যায়, তখন মুজাহিদগণ সুন্নি মুসলিমদের পাশে এসে দাঁড়ান এবং নিজেদের জানের বিনিময়ে মুসলিমদেরকে হেফাজত করতে শুরু করেন। সেই সাথে হুতিদের থেকে সুন্নি অধ্যুষিত এলাকাগুলো নিরাপদ রাখতে এর নিরাপত্তা ভার নিজদের কাঁধে তুলে নেন মুজাহিদগণ।

এই লক্ষ্যে মুজাহিদগণ হুতিদের দখলে চলে যাওয়া সুন্নি অধ্যুষিত এলাকাগুলোও একে একে মুক্ত করতে শুরু করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই আনসারুশ শরিয়াহ্’র মুজাহিদগণ ইয়েমেনের এক-তৃতীয়াংশ অঞ্চল হুতিদের দখল থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হন। পুরো ইয়েমেন যখন যুদ্ধ বিধ্বস্ত, তখন আনসারুশ শরিয়াহ্ নিয়ন্ত্রিত এই অঞ্চলগুলো ছিলো শান্তি-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তায় বেষ্টিত। ফলে মানুষ রাজধানী সানা ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে মুজাহিদদের নিয়ন্ত্রিত এসব অঞ্চলে আসতে শুরু করেন।

কিন্তু যুদ্ধের পুরো চিত্রই পরিবর্তন করে দেয় সৌদি আরব ও আরব আমিরাত। তারা মানসুর হাদিকে ক্ষমতায় বাসানোর নামে হুতি শিয়াদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং ইয়েমেনে আগ্রাসন চালায়।

কিন্তু বাস্তবে দেখা গেলো, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত আল-কায়েদা নিয়ন্ত্রিত সুন্নি অধ্যুষিত এলাকাগুলোকেই তাদের হামলার প্রধান টার্গেটে পরিণত করে এবং সেগুলো দখল করতে শুরু করে। অপরদিকে হুতিদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে নামে মাত্র হামলা চালায় আরব জোট। সেসকল হামলাতেও দেখা গেছে সুন্নি মুসলিমরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

ফলে দেখা যাচ্ছে, ২০১৫ সালে ইয়েমেনে আরব জোট সামরিক আগ্রসন শুরু করার পর থেকে দীর্ঘ ৮ বছরে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ইয়েমেনকে আরও ধ্বংসের দিকে নিয়ে গেছে। দীর্ঘ এই যুদ্ধের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত আরব জোট হুতিদের থেকে রাজধানী সানা এমনকি বড় কোনো শহরও দখল করতে পারেনি। বিপরীতে মুজাহিদদের নিয়ন্ত্রিত সুন্নি অধ্যুষিত এলাকাগুলো দখল করতে গিয়ে হাজার হাজার নিরাপরাধ মানুষকে শহীদ করেছে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব-আমিরাত।

সম্প্রতি আনসারুশ শরিয়াহ্’র আমীর শাইখ খালিদ আল-বাতরাফি হাফিযাহুল্লাহ এক ভিডিও বার্তায় বলেন, যদি সৌদি-আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত ইয়েমেনে আগ্রাসন না চালাতো, তবে সুন্নি মুসলিমরা ইতোমধ্যেই হুতিদের পরাজিত করতে পারতো। কিন্তু আরব জোট এই আগ্রসনের মাধ্যমে সুন্নিদেরকে দুর্বল করে দিয়েছে এবং হুতিদেরকে আরও শক্তিশালী করেছে।

তিনি আরও বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন সত্ত্বেও, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত হুতিদের পরাজিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা ইয়েমেন যুদ্ধে ইরান ও তাদের সমর্থিত হুতিদের কাছে পরাজিত হয়েছে। ফলে ইরানের সাথে তারা এখন সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে শুরু করেছে। সেই সাথে যুদ্ধবিরতি এবং হুতিদের সাথে আলোচনা করতে এক টেবিলে বসেছে।

তিনি আরও বলেন, মুহাম্মাদ বিন সালমান যুদ্ধের শুরুতে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, সে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে যুদ্ধ শেষ করবে। কিন্তু তার এই কয়েক সপ্তাহ আজ ৮ বছরে গড়িয়েছে। এই যুদ্ধে বিন সালমান উম্মাহর সম্পদ প্রায় ৩৫০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে এবং মুসলিমদের রক্ত ঝরিয়েছে। আর সে এখন শিয়াদের সামনে স্পষ্ট পরাজয় স্বীকার করে বসেছে।

এমন পরিস্থিতিতে শাইখ খালিদ আল-বাতরাফি হাফিযাহুল্লাহ আরব উপদ্বীপ ও ইয়েমেনি জনগণকে উদ্দেশ্য করে বলেন, হুতিদের বিরুদ্ধে চলমান এই যুদ্ধ ইসলামের বিজয়ের জন্য। তাই বিজয়ের আগ পর্যন্ত এই যুদ্ধ অব্যাহত রাখতে হবে। এই যুদ্ধের বীরদের সাহায্য ও সমর্থন দিয়ে যেতে হবে।

উল্লেখ্য যে, ২০১৫ সালে সৌদি জোটের আগ্রাসনের ফলে অনেক এলাকা মুজাহিদদের নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যায়। মুজাহিদগণ এখনও পুরোপুরি সেসব এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেননি। তবে আল্লাহর ইচ্ছায় মুজাহিদগণ উল্লেখযোগ্য অংশের নিয়ন্ত্রণ এখনো ধরে রেখেছেন। সেই সাথে মহান রবের সাহায্যে, মুজাহিদগণ সম্প্রতি ইয়েমেনে নতুন করে বিজয়ের ধারা চালু করেছেন- শত্রুদের বিরুদ্ধে সম্মুখ লড়াইয়ে অবতীর্ণ হচ্ছেন, স্নাইপার অভিযানের পাশাপাশি ড্রোন দিয়েও অভিযান পরিচালনা করছেন মুজাহিদগণ।

১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিএসএফের গুলিতে এবার বাংলাদেশি শ্রমিক নিহত
পরবর্তী নিবন্ধভারতে গো-রক্ষা আইন কি মুসলিম নিধনের হাতিয়ার?