ইসলামের তারকাগণ || প্রথম পর্বঃ সাহেবু সিররু রাসূলিল্লাহ্ [রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একান্ত গোপনীয় বিষয় যিনি জানতেন]

2
3407

ما حدثكم حذيفة فصدقوه ، وما أقرأكم عبد الله بن مسعود فأقراؤه

(حديث شريف )

“হুযাইফা তোমাদের যা বলে তোমরা তা বিশ্বাস কর, আর আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ যা শিখায় তোমরা তা শিখ।”(আল-হাদীস)

হযরত হুজায়ফা ইবনুল ইয়ামান রাযিয়াল্লাহু আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্যতম একজন শ্রেষ্ঠ  সাহাবী। হুজাইফা রাযিয়াল্লাহু আনহু মূলের দিক থেকে মক্কার, তবে মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন এবং সেখানেই বড় হন। কেননা তার পিতা মক্কা থেকে ইয়াসরিবে বসবাস শুরু করেছিলেন। হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখার সৌভাগ্য অর্জনের আগেই তিনি মুসলিম হন। মুসলিম হওয়ার পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে একটু দেখার আগ্রহ জন্মে। দিন দিন এ আগ্রহ তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। তিনি সব সময় যাঁরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখেছেন, তাঁদের কাছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেহারা- সুরত ও গুণ-বৈশিষ্ট্য কেমন তা জানার জন্য প্রশ্ন করতেন। শেষে মক্কার প্রথম সাক্ষাতে তিনি প্রশ্ন করেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি কি মুহাজির না আনসার? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জবাব দিলেনঃ তুমি মুহাজির বা আনসার যে কোন একটি বেছে নিতে পার। তিনি বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আনসারই হবো।

______________________________________

মদিনায় মুসলমানদের অন্যান্য সমস্যার মত আরেকটি সমস্যা চেপে বসেছিল। আর তা হল: মুনাফিকদের সমস্যা। তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু অলাইহি ওয়া সাল্লাম, ইসলাম, সাহাবীদের নিয়ে ষড়যন্ত্র করত। তাই  রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হুজাইফা রাযিয়াল্লাহু আনহুর নিকট সেই মুনাফিকদের নামের একটি তালিকা দিয়ে বলেছিলেন তাদের কর্মকাণ্ড ও উদ্যোগের খবরাখবর রাখতে যেন ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের ষড়যন্ত্র প্রতিহত করা যায়।

এ বিষয়টি এতই গোপনীয় ছিল যে, তিনি ব্যতীত আর কোন সাহাবী জানতেন না। এজন্যই হযরত হুজাইফা ইবনুল ইয়ামান রাযি: কে “সাহেবু সিররু রাসূলিল্লাহ্” (যিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একান্ত গোপনীয় বিষয়ের সঙ্গী)  উপাধিতে ডাকা হত।

সারা জীবন তিনি মুনাফিকদের গোপন বিষয়সমূহ আমানত রেখেছেন। এমনকি কোন লোক মারা গেলে হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু জিজ্ঞাসা করতেন, হুজাইফা কি তার জানাযায় উপস্থিত হয়েছে? যদি বলত, হ্যাঁ। তাহলে তিনি জানাযার নামায পড়তেন। আর যদি বলত, না; তাহলে তিনি সন্দেহ করতেন এবং নামায পড়া থেকে বিরত থাকতেন। .

___________________________

হযরত হুজাইফা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে বদর যুদ্ধ ব্যতীত সকল যুদ্ধেই শরীক হয়েছেন।

এ যুদ্ধে হুজাইফা ও তাঁর পিতার যোগদান না করার কারণ সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেছেনঃ আমার বদরে যোগদানে কোন বাধা ছিল না। তবে আমার আব্বার সাথে আমি তখন মদীনার বাইরে আমাদের দীনায় ফেরার পথে কুরাইশ কাফিররা পথরোধ করে জিজ্ঞেস করেঃ তোমরা কোথায় যাচ্ছ? বললামঃ মদীনায়। তারা বললোঃ তাহলে নিশ্চয় তোমরা মুহাম্মাদের কাছেই যাচ্ছে? আমরা বললামঃ আমরা শুধু মদীনায় যাচ্ছি। তা ছাড়া আমাদের আর কোন উদ্দেশ্য নেই। অবশেষে তারা আমাদের পথ ছেড়ে দিল। তবে, তারা আমাদের থেকে একটি অঙ্গীকার নিল। অঙ্গীকারটি হলো, আমরা মদীনায় গিয়ে কুরাইশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কোনভাবে সাহায্য করবো না। তাদের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে আমরা মদীনায় পৌঁছলাম এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কুরাইশদের নিকট কৃত অঙ্গীকারের কথা বলে জিজ্ঞেস করলামঃ এখন আমরা কী করবো? বললেনঃ তোমরা তোমাদের অঙ্গীকার পূরণ কর। আর আমরা তাদের বিরুদ্ধে বিজয়ের জন্য আল্লাহর সাহায্য চাইবো।

পরে হযরত হুজাইফা উহুদ যুদ্ধে তাঁর পিতার সাথে যোগদান করেন। তিনি দারুণ সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেন এবং নিরাপদে মদীনায় ফিরে আসেন। তবে তাঁর বৃদ্ধ পিতা শাহাদাতবরণ করেন। আর সে শাহাদত ছিল স্বপক্ষীয় মুসলিম সৈনিকদের হাতে। ঘটনাটি এ রকমঃ

হুজাইফার পিতা আল-ইয়ামান শহীদ হন মুসলমানদের হাতে। না চেনার কারণে এবং যুদ্ধের ঘোরে এমনটি ঘটে যায়। হুজাইফা কিছু দূর থেকে পিতার মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে চিৎকার দিয়ে ওঠেনঃ ‘আমার আব্বা, আমার আব্বা’ বলে। কিন্তু সে চিৎকার কারো কানে পৌঁছেনি। যুদ্ধের শোরগোলে তা অদৃশ্যে মিলিয়ে যায়। ইতিমধ্যে বৃদ্ধ নিজ সঙ্গীদের তরবারির আঘাতে ঢলে পড়ে গেছেন। হুজাইফা পিতার মৃত্যু নিশ্চিত হয়ে শুধু একটি কথা উচ্চারণ করেঃ

(غفر الله لكم، وهو أرحم الراحمين)

‘আল্লাহ আমাদের সকলকে ক্ষমা করুন। তিনিই সর্বাধিক দয়ালু।’

হযরত রাসূলে কারীম সা. হুজাইফাকে তাঁর পিতার ‘দিয়াত’বা রক্তমূল্য দিতে চাইলে তিনি বললেনঃ আমার আব্বা তো শাহাদাতেরই প্রত্যাশী ছিলেন, আর তিনি তা লাভ করেছেন। হে আল্লাহ, তুমি সাক্ষী থাক, আমি তাঁর দিয়াত বা রক্তমূল্য মুসলমানদের জন্য দান করে দিলাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  দারুণ খুশী হলেন।

_____________________

পরবর্তীতে উমর রাযিয়াল্লাহু আনহুর শাসন আমলে হুজাইফা রাযিয়াল্লাহু আনহুকে উমর ইবনুল খাত্তাব মাদায়েন শহরে গভর্নর নিযুক্ত করেন। তখন তিনি তাঁর গাধার উপর সওয়ার হয়ে তাদের দিকে রওয়ানা করেন। তাঁর হাতে একটি রুটি ছিল। তিনি তাদের নিকট পৌঁছে তাদের অবস্থা দেখে পেরেশান হয়ে যান। অতঃপর তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, “তোমরা ফেৎনা থেকে বেঁচে থাক”। তারা যখন তাঁর উদ্দেশ্যের বিষয়ে জানতে চাইল তখন তিনি তাদের বলেন, তোমরা গভর্নর ও আমীরদের এমন বিষয়ে প্রশংসা করো না যা তাদের মধ্যে নেই।

সম্মানিত সাহাবী হযরত হুজাইফাতুল ইয়ামান রাযিয়াল্লাহু আনহু ৩৬ হিজরীতে ইন্তেকাল করেছেন। ইন্তেকালের পূর্ব মূহুর্তে সাহাবায়ে কেরাম যখন উনার কাছে গেলেন, তিনি তখন কাদঁতে ছিলেন। মৃত্যুশয্যায় শায়িত অবস্থায় তিনি বলেছিলেন, আমি দুনিয়া ছেড়ে চলে যাচ্ছি এই আফসোসে কাদঁছি না, বরং মৃত্যুকে আমি ভালবাসি। আমি কাদঁছি আমি যাঁর কাছে রওয়ানা দিয়েছি তিনি আমার প্রতি সন্তুষ্ট নাকি অসন্তুষ্ট তা আমার জানা নেই।

তথ্যসূত্র:

সুয়ারুম মিন হায়াতিস সাহাবাঃ আব্দুর রহমান পাশা

সিফাতুস সফওয়াহঃ  আল-জাওযী

উসদুদ গাবাহ ফি মারিফাতিস সাহাবাঃ ইবনে আসির

প্রাপ্তিস্থানঃ ইসলাম ওয়েব

 

2 মন্তব্যসমূহ

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধফটো রিপোর্ট ||২০শে শাওয়াল, ১৪৪০হিজরী || আলেপ্পো, লাতাকিয়া এবং হামার পল্লী অঞ্চলে তানযিম হুররাস আদ-দ্বীনের মুজাহিদিনের রিবাতের দায়িত্বপালন!
পরবর্তী নিবন্ধজিনাকারীদের উপর ইসলামী আইন প্রয়োগ করলো আল-কায়দার একটি শরয়ী আদালত!