করোনা সংক্রমণে “আতংকিত নয়, সচেতন হোন”

    0
    1561
    করোনা সংক্রমণে “আতংকিত নয়, সচেতন হোন”

    করোনা সংক্রমণে “আতংকিত নয়, সচেতন হোন”

    করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার আতংকে আছেন? এতো আতংক কীসের? আপনি মুসলিম না? মুসলিমদের এই মহামারী নিয়ে আতংকিত হওয়ার তেমন কিছু নেই। আতংকিত নয়, সচেতন হওয়াই কাম্য। এটা আমি যেমন আজ আপনাদের বলছি, তেমনি নাস্তিক্যবাদীরাও বলছে। পার্থক্য কোথায়?
    তারা মানুষকে বলছে, ভয় পাবেন না, সচেতন থাকুন। আচ্ছা, ভয় পাবে না কেন? রোগাক্রান্ত হলে কষ্ট পায়, মৃত্যু হতে পারে—এগুলো জানার পরও একজন মানুষের ভয় না পাওয়ার কী কারণ থাকতে পারে? নাস্তিক্যবাদীরা এগুলোর ব্যাখ্যা তো করেইনি, বরং তাদের কথা হলো- আপনারা আক্রান্ত হলেও ঘরেই থাকুন, হাসপাতালে যাবেন না, ভয় পাবেন না, অন্যদেরকে আক্রান্ত করবেন না ইত্যাদি। ধর্ষণসহ অন্যান্য সকল অপরাধ রোধের ক্ষেত্রেও এই নাস্তিক্যবাদীরা এই ধরণের ‘স্ববিরোধী’ কথা বলে থাকে। তারা বলে, ধর্ষণ করবেন না, চুরি করবেন না। কিন্তু, কেন করবে না? ধর্ষণ না করার দ্বারা কী লাভ? যারা আখিরাতে বিশ্বাসী নয়, তারা কোনো মেয়েকে ধর্ষণের সুযোগ পেলে কী কারণে ধর্ষণের সুযোগ হাতছাড়া করবে? কেন মানবতা দেখাতে হবে? মানবতা না দেখালে কী ক্ষতি? দুনিয়া অর্জনই যার উদ্দেশ্য, সে কেন দুনিয়ার কোনো ভোগের বস্তুকে ছেড়ে দিবে? এগুলোর কোনো কিছুই এই নাস্তিক্যবাদীরা ব্যাখ্যা করতে পারবে না। ঠিক তেমনি করোনাভাইরাসের মহামারী প্রতিরোধে নাস্তিক্যবাদী সরকার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা তো নেয়নি, আবার বলছে আতংকিত হবেন না! মানুষ মারা যাচ্ছে, রোগাক্রান্ত হয়ে কষ্ট পাচ্ছে—তারপরও আতংকিত না হওয়ার কী কারণ থাকতে পারে? এই প্রশ্নের সদুত্তর নাস্তিক্যবাদীরা দিতে না পারলেও, ইসলাম এই প্রশ্নের যথাযথ উত্তর প্রদান করেছে।
    একজন মুসলিম রোগাক্রান্ত হলে বা মহামারীতে মারা যাওয়ার আশংকা হলেও কেন ভয় পাওয়া উচিত নয়—এই বিষয়ে ইসলাম কথা বলেছে। ইসলাম বলছে, রোগাক্রান্ত হলে একজন মুসলিমের উচিত ধৈর্যধারণ করা, আল্লাহর উপর ভরসা করা। এতে, তার কী লাভ? তার লাভ হলো- তার গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
    الْمَرِيضُ تَحَاتّ خَطَايَاهُ كَمَا يَتَحَاتّ وَرَقُ الشّجَرِ.
    অসুস্থ ব্যক্তির গোনাহগুলো ঝরে যায়, যেমন (শীতকালে) গাছের পাতা ঝরে পড়ে। (মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৬৬৫৪)
    আরেক হাদীসে ইরশাদ হয়েছে-
    مَا مِنْ مُسْلِمٍ يُصِيبُهُ أَذًى مِنْ مَرَضٍ، فَمَا سِوَاهُ إِلّا حَطّ اللهُ بِهِ سَيِّئَاتِهِ، كَمَا تَحُطّ الشّجَرَةُ وَرَقَهَا.
    কোনো মুসলিম যখন অসুস্থতা বা অন্য কোনো কষ্টে নিপতিত হয় আল্লাহ তার গোনাহগুলো মিটিয়ে (ঝরিয়ে) দেন, যেমন (শীতকালে) গাছ তার পাতা ঝরায়। (সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৭১)
    শুধু গোনাহমাফিই নয়, মুমিনের নেকীর খাতাও সমৃদ্ধ হতে থাকে অসুস্থ অবস্থায়; যাতে আফসোস করতে না হয়- অসুস্থতার কারণে আমি কত নেক আমল থেকে বঞ্চিত হচ্ছি, সুস্থ থাকলে তো আমি তাহাজ্জুদ-তিলাওয়াতসহ অন্যান্য নেক আমল করতে পারতাম। এখন তো কিছুই করতে পারছি না।
    রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে সান্ত্বনার বাণী শুনিয়েছেন-
    إِذَا مَرِضَ العَبْدُ، أَوْ سَافَرَ، كُتِبَ لَهُ مِثْلُ مَا كَانَ يَعْمَلُ مُقِيمًا صَحِيحًا.
    যখন বান্দা অসুস্থ হয় বা সফরে থাকে তখন সুস্থ অবস্থায় বা বাড়িতে থাকা অবস্থায় সে যে নেক আমল করত তার সওয়াব লেখা হতে থাকে (যদিও অসুস্থতা বা সফরের কারণে সে উক্ত নেক আমলগুলো করতে পারছে না)। -(সহীহ বুখারী, হাদীস ২৯৯৬; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৬৬৭৯)
    একবার নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসুস্থ উম্মুস সায়েব বা (তার নাম ছিল) উম্মুল মুসায়্যিবকে দেখতে গেলেন। তখন তিনি জ্বরে কাঁপছিলেন। নবীজী বললেন, তুমি কাঁপছো কেন? তিনি বললেন, আল্লাহর রাসূল! জ্বর এসেছে। এবং বললেন, ‘লা- বারাকাল্লাহু ফী-হা’ অর্থাৎ সে জ্বরের জন্য বদদুআ করল। তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
    لَا تَسُبِّي الْحُمّى، فَإِنّهَا تُذْهِبُ خَطَايَا بَنِي آدَمَ، كَمَا يُذْهِبُ الْكِيرُ خَبَثَ الْحَدِيدِ.
    (বদদুআর মাধ্যমে) জ্বরকে গালি দিয়ো না। কারণ, তা বনী আদমের গোনাহগুলো মিটিয়ে দেয়, যেমন কামারের হাপর লোহার জং দূর করে। (সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৭৫; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ২৯৩৮; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ৯৩৭৯)

    অর্থাৎ, হাদিসসমূহ থেকে বুঝা গেল যে, মুমিনের রোগ-শোকের কারণে আল্লাহ তা’য়ালা তার গোনাহসমূহ ক্ষমা করেন। গোনাহ ক্ষমা করলে একজন মুসলিমের কী লাভ? এই প্রশ্নের উত্তর প্রত্যেক মুসলিম জানে। গোনাহ মুসলিমকে অস্বস্তি দেয়, নিজের কৃত গোনাহ নিয়ে একজন মুসলিম দুশ্চিন্তায় থাকে—না জানি এ গোনাহ তার জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হয়। আর, যখন সে জানতে পারে যে, অসুস্থতার মাধ্যমে তার গোনাহগুলো ক্ষমা করে দেওয়া হয়, তখন সে কেন খুশি হবে না? অবশ্যই একজন মুসলিম তার গোনাহ ক্ষমা হলে খুশি হয়। এজন্য, অসুস্থতাবস্থায় কোনো মুসলিম আতংকিত তো হবেই না, বরং রোগের কারণে বাহ্যিক কষ্ট হলেও সে তার গোনাহসমূহ মাফ পাওয়ায় মানসিকভাবে স্বস্তিতে থাকবে, অন্তরে আনন্দ থাকবে।
    এখন কথা হলো, করোনাভাইরাসের মতো এরকম কোনো মহামারীতে তো কেবল রোগাক্রান্তই হচ্ছে না, মারাও যাচ্ছে। তাহলে, একজন ব্যক্তি যখন জানে যে, সে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারাও যেতে পারে, তখনও কেন সে আতংকগ্রস্ত হবে না? যারা দুনিয়ার চাওয়া-পাওয়াকেই সবকিছু মনে করে, এখানের ভোগই যাদের উদ্দেশ্য, যে তার দুনিয়া গুছিয়েছে, সে তো তার এই গুছানো দুনিয়া ছেড়ে যেতে চাইবেই না। তাই, স্বাভাবিকভাবেই সে মৃত্যুর কথা শুনে আতংকিত হবে, নাস্তিক্যবাদীদের “আতংকিত হবেন না, সচেতন হোন” ধরণের বুলি তাকে প্রভাবিত করতে পারবে না। রোগ থেকে মুক্তির জন্য তার ভরসাস্থল ছিল ঔষধ। কিন্তু, করোনাভাইরাস নিরাময়ের তো কোনো ঔষধ বের হয়নি! সে আর কার উপর ভরসা করবে? নাস্তিক্যবাদী মিডিয়া ‘প্রথম আলো’ও এই কথাই বলছে, “এই রোগ নিয়ে এত আতঙ্কের কারণ হচ্ছে এখন পর্যন্ত এর কোনো টিকা বা প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি।”
    পক্ষান্তরে, আল্লাহর সাক্ষাতের প্রত্যাশী কোনো মুসলিম মৃত্যুকে ভয় পায় না, মৃত্যুর কথা শুনে আতংকিত হয় না। কারণ, দুনিয়াকে তারা চিরস্থায়ী আবাস মনে করে না, ক্ষণস্থায়ী এই দুনিয়ার জীবন কোনো মতে অতিবাহিত করে, রবের সন্তুষ্টি অর্জন করে চিরস্থায়ী আখিরাতই তাদের কাম্য। দুনিয়াতে তাদের কাজ ভোগে মত্ত থাকা নয়, বরং আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন থাকা। অর্থাৎ, তারা আখিরাত গুছায়। তাই, কষ্টের দুনিয়া ছেড়ে স্বাভাবিকভাবেই তারা তাদের গুছানো জায়গায় যেতে চায়। তাছাড়া, তারা আখিরাতে তাদের রবের সাক্ষাতের প্রত্যাশী, রবের প্রতিশ্রুত জান্নাতের প্রত্যাশী। আর, মৃত্যু তাদের এই সকল প্রত্যাশার পথে প্রধান বাধা। তাই, তারা মৃত্যুকে ভয় তো পায়ই না, বরং রবের সন্তুষ্টির উপর মৃত্যুবরণ করাকে নিজেদের সফলতা হিসেবে দেখে। আর, করোনাভাইরাসের মতো মহামারীতে মৃত্যুবরণ করাকে ভয় না পাওয়ার আরেকটি বিশেষ কারণ হলো- এই সকল মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করা মুসলিম শহীদের সমান সওয়াব পায়।
    প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
    فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الشُّهَدَاءُ سَبْعَةٌ سِوَى الْقَتْلِ فِي سَبِيلِ اللهِ الْمَطْعُونُ شَهِيدٌ وَالْغَرِقُ شَهِيدٌ وَصَاحِبُ ذَاتِ الْجَنْبِ شَهِيدٌ وَالْمَبْطُونُ شَهِيدٌ وَالْحَرِقُ شَهِيدٌ وَالَّذِي يَمُوتُ تَحْتَ الْهَدْمِ شَهِيدٌ وَالْمَرْأَةُ تَمُوتُ بِجُمْعٍ شَهِيْدٌ.
    আল্লাহর পথে নিহত হওয়া ছাড়াও শহীদ সাত প্রকারের: (ক) তাউনে (মহামারীতে) মৃত ব্যক্তি শহীদ, (খ) যে ডুবে মারা যায় সে শহীদ, (গ) ফুসফুসে রোগাক্রান্ত মৃত ব্যক্তি শহীদ, (ঘ) পেটের পীড়ায় মৃত ব্যক্তি শহীদ, (ঙ) যে পুড়ে মারা যায় সে শহীদ, (চ) কোন কিছু চাপা পড়ে যে মারা গেছে সে শহীদ, (ছ) আন্তঃসত্ত্বায় মৃত মহিলা শহীদ। ( আবূ দাঊদ ৩১১১, নাসাঈ ১৮৪৬)
    এতোসব পুরষ্কারের ঘোষণা থাকা সত্ত্বেও কোনো মুসলিম করোনাভাইরাসের কারণে আতংকিত হবে—এটা ভাবা যায় না। স্বাভাবিকভাবেই, একজন মুসলিম রোগ-শোক তথা কোনো বিপদে আতংকিত না হয়ে ধৈর্যধারণ করবে, আল্লাহর উপর ভরসা করবে। পাশাপাশি, সতর্কতা অবলম্বন করবে। কেননা, সতর্কতা অবলম্বনও একজন মুসলিমের বৈশিষ্ট্য, ইসলামের নির্দেশ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

    إِذَا سَمِعْتُمْ بِالطَّاعُونِ بِأَرْضٍ فَلَا تَدْخُلُوهَا وَإِذَا وَقَعَ بِأَرْضٍ وَأَنْتُمْ بِهَا فَلَا تَخْرُجُوا مِنْهَا
    “কোন এলাকায় তোমরা মহামারীর সংবাদ শ্রবণ করলে সেখানে প্রবেশ করবে না। আর কোনো এলাকায় থাকা অবস্থায় যদি মহামারী শুরু হয়, তবে তোমরা সেখান থেকে বের হবে না”। (বুখারী হাদিস ৫৭২৯, মুসলিম হাদিস ৫৯১৫)
    সুতরাং, করোনাভাইরাস সংক্রমণের ব্যাপারে মুসলিমরা আতংকিত হবে না, সতর্ক হবে। তবে, এখন নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে যে, আমি কি সত্যিই মুসলিম হতে পেরেছি? নিজের জীবনকে কতটুকু ইসলাম অনুযায়ী পরিচালনা করছি?
    প্রিয়! এখনও কি রবের সামনে দণ্ডায়মান হওয়ার ভয় হৃদয়ে ঢুকেনি? দুচোখের অশ্রু ফেলে মালিকের কাছে তওবা করার সময় কি তবুও আসেনি?
    আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাঁর পূর্ণ আনুগত্য করে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের তৌফিক দান করুন, আমাদেরকে করোনাভাইরাসের মহামারী থেকে হেফাজতে রাখুন। অসুস্থ মুসলিমদের সুস্থতা দান করুন। আমীন ইয়া রাব্বাল আলামীন।

    লেখক: খালিদ মুন্তাসির

    মন্তব্য করুন

    দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
    দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

    পূর্ববর্তী নিবন্ধকরোনা’র তথ্য কি সরকার গোপন করছে?
    পরবর্তী নিবন্ধডিসি’র নাম করে পুলিশের চাঁদা দাবি!