ভিপি নূর, তন্ময়, নাকি গণতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা- দায় কার?

0
2006

সম্প্রতি সাবেক ডাকসু ভিপি ও গণঅধিকার পরিষদের সদস্য সচিব নুরুল হক নূরের সঙ্গে ইসরায়েলের ক্ষমতাসীন লিকুদ পার্টির সদস্য মেন্দি এন সাফাদির হাস্যোজ্জ্বল একটি ছবি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। সাফাদির সঙ্গে দুবাইয়ে ভিপি নুর বৈঠক করেছে- এই দাবি করে সামাজিক মাধ্যমে একটি পোস্ট দিয়েছে বুয়েট ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এবং আওয়ামীলীগের প্রোপ্যাগান্ডা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফর্মেশন (CRI)-এর সমন্বয়ক তন্ময় আহমেদ।

ভিপি নূর ও তার অনুসারীসহ সরকার বিরোধীরা এই ছবিকে এডিট করা বলছে। পাশাপাশি, মেন্দি এন সাফাদির সাথে বৈঠকের কথা অস্বীকার করেছে নূর নিজেও।

এর ঠিক পরেই আমরা দেখেছি যে, তন্ময় আহমেদ আবার একটি অডিও ফাঁস করেছে, যেখানে এক ব্যক্তির সাথে আলাপকালে মেন্দির সাথে মিটিংএর বিষয়ে নূরকে কথা বলতে শোনা গেছে। ঐ অডিওতে নূর এক পর্যায়ে ফোনের ঐ ব্যক্তিকে মিটিং-এর ছবি ফাঁস হওয়ায় তিরস্কার করেছে; এটাকে সে “বিশ্বাসের ঘাতকতা” বলেছে।
তবে এই কল রেকর্ডকেও বানোয়াট বলছে নূর ও তার অনুসারীরা।

এর আগে ২০১৬ সালে বিএনপির তৎকালীন যুগ্ম-মহাসচিব আসলাম চৌধুরীও ভারতের দিল্লিতে এই ইসরায়েলী মেন্দি এন সাফাদির সাথে সাক্ষাত করে। সেই ছবি ভাইরাল হওয়ার পর তাকে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের অভিযোগে গ্রেফতার করে আওয়ামী লীগ সরকার।

কিন্তু হিন্দুত্ববাদী ভারতের তাঁবেদার আওয়ামী লীগ নিজেও ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে এই ইহুদিবাদী চরের সাথে যোগাযোগ করেছে বলে জানিয়েছে মেন্দি এন সাফাদি নিজেই। বিবিসির সাথে এক সাক্ষাৎকারে সাফাদি বলে, বিএনপি নেতা আসলাম চৌধুরীর সাথে দিল্লিতে তার দেখা হওয়ার আগেই যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের সাথে ওয়াজেদের দপ্তরে দুজনের কথাবার্তা হয়।

সাফাদি জানায়, বৈঠকে সজীব ওয়াজেদই মূলত কথা বলেছে, আর সে শুধু শুনেছে। এসময় হাসিনার পুত্র জয় তার কাছে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে যে, বাংলাদেশের সরকার কত ভাল কাজ করছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের সঙ্গে বর্তমান সরকারের সম্পর্ক কত ভাল।

এভাবে, বাংলাদেশের রাজনীতির দুই প্রভাবশালী দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ এবং তরুণ রাজনীতিবিদদের একাংশ নিজেদেরকে বাংলাদেশে ইসরাইলিদের বিশ্বস্ত চর প্রমাণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

যদিও নূরের মিটিং-এর বিষয়টি এখনো সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে প্রমাণিত নয়, পক্ষে-বিপক্ষে এখনো আলোচনা চলছে, যুক্তি-পাল্টা যুক্তি দেখানো হচ্ছে। তবে ফেইস দা পিপল নামের একটি অনলাইন টক-শোতে নূর বলেছে যে, সাফাদির সাথে মিটিং যদি হয়েও থাকে, তাতে কি হয়েছে?

নূরের ভাষায়, “…যদি সুযোগ থাকতো, তাদের সাথে প্রয়োজনে মোসাদ, এমআইসিক্স, সিআইএ, যেকোন দেশের গোয়েন্দা সংস্থা বলেন, রাজনীতিবিদ বলেন, ডিপ্লোমেট বলেন, তাদের সাথে মিটিং করে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় যদি ভূমিকা রাখতে পারতাম, সেই কাজটা তো করতাম। তা তো আমরা প্রকাশ্যেই বলছি।”

অথচ অবৈধ ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েলের সাথে বাংলাদেশের কোনো ধরনের সম্পর্ক রাখার বৈধতা বিদ্যমান আইনেও নেই। তবুও বিভিন্ন সময় ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক গড়ার কিংবা তাদের সুনজরে আসার চেষ্টা করছে বাংলাদেশের ক্ষমতালোভী রাজনীতিকরা। আওয়ামীলীগ সরকার গত বছর পাসপোর্ট থেকে ‘except Israil’ কথাটি বাদ দিয়ে সেখানে বাংলাদেশিদের যাতায়াতের সুযোগ করে দিয়েছে।

কথিত গণতন্ত্রপন্থী দলগুলোর বিদেশ-নির্ভরতা প্রমাণিত বিষয়।

আওয়ামীলীগের নেত্রী শেখ হাসিনা বলেছে যে, “আমরা ভারতকে যা দিয়েছি, সেটা ভারত কোনদিন ভুলতে পারবে না।” আর তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতবর্ষে গিয়ে ‘হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে যা যা করা দরকার সেটা যেন তারা করে’- সেই অনুরোধ করে আসে।

আওয়ামীলীগের মতো বিএনপি নেতৃত্ব হয়তো সকল বিষয়ে এতো ছাড় দেয়নি; তবে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট ভাষায় বলেছে যে, “বিএনপি কিন্তু জামায়াত নয়। বিএনপি ইসলামি আইনে বিশ্বাস করে না। বিএনপি মৌলবাদে বিশ্বাস করে না।” তার বক্তব্যে এটা স্পষ্ট যে, ইসলাম ও শরয়ি শাসন সম্পর্কে আওয়ামীলীগ ও বিএনপির অবস্থান এক ও অভিন্ন।

আর ইসারাইলি গোয়েন্দা সাফাদির সাথে ভিপি নূরের বৈঠক বা আঁতাতের বিষয়টি এখনো নিরপেক্ষভাবে প্রমাণিত না হলেও, বিভিন্ন বিদেশি কূটনৈতিক মিশন ও কূটনীতিকদের সাথে তার উঠা-বসা-মিটিং একটি প্রমাণিত বিষয়। সে নিজেও তার বক্তব্যে বলেছে যে, গণতন্ত্রের প্রয়োজনে সে মোসাদ-সিআইএ-এমআইসিক্স এর মতো ইসলামের চিরশত্রুদের সাথেও বৈঠক বা আপোশ করতে রাজি। তাই নূরের কাছেও যে ইসলাম ও মুসলিমদের স্বার্থের চেয়ে কথিত গণতন্ত্র বা ক্ষমতা বেশি গুরুত্বপূর্ণ- এটা সে তার কথা ও কাজে স্পষ্ট করে দিয়েছে। আর বিদেশি “বন্ধু”রা যে তাকে স্বার্থ ছাড়া সাহায্য করবে না, সেটা জানা বা বুঝার মতো জ্ঞান অন্তত নূরের রয়েছে বলে আমরা ধারণা করি।

নূরের দল গণঅধিকার পরিষদের আহব্বায়ক রেজা কিবরিয়াও পশ্চিমা আদর্শে বিশ্বাসী তল্পিবাহক। সে আইএমএফ সহ বিভিন্ন পশ্চিমা সংস্থায় দীর্ঘদিন কাজ করেছে, যাদের অন্যতম এজেন্ডা হল ইসলাম ও মুসলিমদেরকে দমিয়ে রাখা। বাংলাদেশে তাই ভবিষ্যতে পশ্চিমারা নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে তাদেরই তৈরি করা গণতান্ত্রিক আদর্শধারী নূর-কিবরিয়াদের উপর কিংবা ‘ইসলামি আইনে বিশ্বাস না করা’ বিএনপির উপর ভরসা করতেই পারে!

আর মেন্দি এন সাফাদি সম্পর্কে আরেকটি বিষয় হল, সে কেবল ইসরায়েলী রাজনীতিক কিংবা সন্দেহভাজন গোয়েন্দা সদস্যই নয়, উগ্র হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীর সাথেও তার আঁতাত রয়েছে। সে ‘বিশ্ব হিন্দু সংগ্রাম কমিটি (ওয়ার্ল্ড হিন্দু স্ট্রাগল কমিটি)’-এরও একজন কার্যকরী সদস্য। আর এই সংগঠনটি মূলত বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের কল্পকাহিনী ছড়ায় এবং ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষ উসকে দেয়। সংগঠনটির সভাপতি হচ্ছে শিপন কুমার বসু নামে এক উগ্র হিন্দু।

এমন একটি সংগঠনের সদস্য ইসরায়েলী ব্যক্তির সাথে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বরা গোপন বৈঠক করছে। এটা যে ক্ষমতায় আসার জন্য দেশকে বিক্রি করে দেওয়ার শামিল, সেটা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই।

গণতন্ত্রের বিষবৃক্ষ ও আমাদের করনীয়

এখানে তাই আমাদেরকে এটা মাথায় রাখতে হবে যে, ব্যক্তি নূর, ব্যক্তি রেজা কিবরিয়া বা ব্যক্তি মির্জা ফখরুলরদের হয়তো সাধারণ জনতার কাছে ক্লিন ইমেজের মানুষ হিসেবে পরিচিতি আছে; তবে তারা এলিট গণতান্ত্রিক সিস্টেমকে আদর্শ হিসেবে দৃঢ়ভাবে ধারণ করে। ক্ষমতা পেতে হলে বা ধরে রাখতে হলে তাদেরকে অবশ্যই তাদের দলের নেতাদের পাশাপাশি পশ্চিমা পরাশক্তিগুলোকে “খুশি” রেখেই চলতে হবে। এই দুষ্টচক্রের বাইরে তারা কখনোই বের হতে পারবে না; গণতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা তাদেরকে কখনোই এর থেকে বাইরে যেতে দিবে না। আবার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে কিংবা মানুষ তাদের ব্যপারে অতিষ্ঠ হয়ে গেলে পশ্চিমারা আবারো ‘জনগণের পক্ষ নেওয়া’র অভিনয় করে নতুন কোন নূর বা নতুন কোন রেজা কিবরিয়াকে খুঁজে নেবে।

মোবারক-গাদ্দাফিরা G-20 সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়েও শেষরক্ষা করতে পারেনি; নওয়াজ শরীফ-পারভেজ মোশার্‌রফরা পশ্চিমাদের হুকুম তামিল করেও মসনদে টিকে থাকতে পারেনি। আন-নাহদা ইসলামি আদর্শে ব্যাপক ছাড় দিয়েও ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে।

কথিত পরাশক্তিগুলোর এই দাসত্বের চক্রেই আটকে আছে বাংলাদেশ-পাকিস্তান-ইন্দোনেশিয়া-সুদান ও তিউনিসিয়া-লিবিয়ার মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো ও তাদের মুসলিম জনগণ।

এই চক্র থেকে একমাত্র তখনই বের হওয়া সম্ভব, যখন পশ্চিমাদের এই কথিত গণতন্ত্রের জিঞ্জির ছুঁড়ে ফেলা যাবে, যখন ইসলামের পতাকাতলে একত্রিত হয়ে পশ্চিমাশক্তি ও তাদের বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো যাবে। আর কেবলমাত্র তখনই এদের তাঁবেদারদেরকে পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত ক্ষমতার মসনদ থেকে উৎখাত করে দেশ ও জনগণকে মানবরচিত বিধান তথা মানুষের গোলামি থেকে মুক্ত করে মহাপরাক্রমশালী এক আল্লাহ্‌র ইবাদতে ফিরিয়ে নেওয়া যাবে।

উদাহরণ আমাদের সামনে ইতিমধ্যে আফগান মুসলিমরা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। তাঁরা ‘জোর করে চাপিয়ে দেওয়া বিশ্বব্যবস্থা’র বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে একে একে সবগুলো কথিত পরাশক্তির কবর রচনা করেছে আফগানের মাটিতে। সোমালিয়া ও মালি অঞ্চলের মুসলিমরাও সেই পথে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে গেছেন অনেকদূর। পাকিস্তান ও ইয়েমেনের মুসলিমরাও সেই পথেই হাঁটছেন। আর আমাদের ভাগ্যও আল্লাহ তা’আলা ততক্ষণ পরিবর্তন করবেন না, যতক্ষণ আমরা নিজেরা চেষ্টা না করবো।

আমরা এখন আমাদের ও আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের গতিনির্ধারণের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি। আমাদেরকে তাই সততা ও সাহসের সাথে নিজেদের কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে হবে, খুব দ্রুতই। কেননা হিন্দুত্ববাদীরা আমাদের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে; বৌদ্ধরা ইতিমধ্যে তাদের আগ্রাসন শুরু করে দিয়েছে, আর খ্রিস্টান শক্তিতো তাদের প্রভাব বিস্তার করেই ফেলেছে আমাদের এই ছোট্ট ভূখণ্ড ঘিরে।

সময় বেশি বাকি নেই আমাদের হাতে।



লিখেছেন : আব্দুল্লাহ বিন নজর

 



তথ্যসূত্র :
1. মেন্দির সাথে বৈঠক: নিজ মুখেই স্বীকারোক্তি নুরের
https://tinyurl.com/2p6933a4
2. যদি সুযোগ থাকতো,
https://tinyurl.com/yeyuuy6m
3. দেশে ফিরেই গণমাধ্যমকে যা জানালেন ভিপি নূর
https://tinyurl.com/29kdcns2
4. বিএনপির প্রস্তাবের অপেক্ষায় গণ অধিকার পরিষদ | Reza Kibria
https://tinyurl.com/jz3n5j7s
5. বিএনপি শরীয়াহ আইনে বিশ্বাস করে না: মির্জা ফখরুল
https://tinyurl.com/32m5thex

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধ২০২২: মুসলিমদের বাড়িঘরে ‘বুলডোজার চালানোর’ বছর
পরবর্তী নিবন্ধসীমান্তে বিএসএফের সন্ত্রাস: বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে বৃদ্ধাকে মারধর ও যুবককে গুলি