এ পর্যন্ত নভেল করোনা ভাইরাস ছড়িয়েছে বিশ্বের ১১৯টি দেশ ও অঞ্চলে। গত আড়াই মাসে বিশ্বজুড়ে আক্রান্ত হয়েছেন এক লাখেরও বেশি মানুষ। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছেন তিন জন। করোনা প্রতিরোধে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নিচ্ছে নানা রকম ব্যবস্থা। তবে বাংলাদেশে এ সংক্রান্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখনও নাজুক। দেশের প্রবেশপথগুলোতে নেই করোনা শনাক্ত বা সংক্রমণ প্রতিরোধের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। প্রধান বিমানবন্দর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের শনাক্তের ব্যবস্থায় রয়েছে সমন্বয়হীনতা ও দুর্বলতা। গত আড়াই মাসেও এর সমাধান সম্ভব হয়নি।
গত ২৭ ফেব্রুয়ারি অস্ট্রেলিয়ার সিডনি থেকে দেশে আসেন মোহাম্মদ হালিম। প্লেন থেকে নামার পর তাকে একটি হেলথ কার্ড দেওয়া হয়। সেটি হাতে করে ভেতরে আসতেই বিমানবন্দরে থাকা স্বাস্থ্যকর্মীরা তাকে জানান, কার্ডটি পূরণ করার দরকার নেই, খালি ফর্ম জমা দিয়ে ডেস্ক থেকে হেলথ কার্ড নিয়ে চলে যান। মোহাম্মদ হালিম বলেন, ‘ডেস্ক থেকে কার্ড নিয়ে চলে এলাম। আমি জানি না, হেলথ কার্ড যে আমাকে নিতে বললো, সেটা কেনইবা নিতে বলা হলো। এর কাজটা কী সেটাও বুঝলাম না। আমাদের তো ফর্মটাই পূরণ করতে দেয়নি। তাহলে তারা আমাদের খোঁজ নেবে কী করে। সেই কার্ড নিয়ে আমরা কী করবো, কোথাও জমা দিতে হবে কিনা কিছুই বলা হয়নি।’
বিমানবন্দরে প্রায় সময়েই কিছু কিছু এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে যাত্রীদের হেলথ ডিক্লারেশন কার্ড সরবরাহ করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ফলে যাত্রীদের বিমানবন্দরে এসে এই কার্ড পূরণ করে জমা দিতে হচ্ছে। এর ফলে বিমানবন্দরে স্ক্যানিং জোনে বাড়তি চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। অন্যদিকে কোনও কোনও যাত্রী হেলথ ডিক্লারেশন কার্ড জমা না দিয়েই বিমানবন্দর ত্যাগ করছেন। ১০ মার্চ বিমানবন্দরে এক বৈঠকে এ বিষয়গুলো তুলে ধরেন বিমানবন্দরের স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসকরা। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, সৌদি অ্যারাবিয়ান এয়ারলাইন্সসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি এয়ারলাইন্স ফ্লাইটে যাত্রীদের হেলথ ডিক্লারেশন কার্ড সরবরাহ করছে না।
বিমানবন্দর সূত্রে জানা গেছে, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে গড়ে প্রতিদিন প্রায় ২০ হাজার যাত্রী যাতায়াত করেন। ২০১৮ সালে শাহজালাল বিমানবন্দরের আন্তর্জাতিক যাত্রী ছিল ৭০ লাখ ৭৪ হাজার ৯২৪ জন। ২০১৯ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৩ লাখ ১৬ হাজার ১২৫ জনে। বিশ্বজুড়ে ইবোলা সংক্রমণ শুরু হলে ২০১৪ সালের নভেম্বরে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তিনটি থার্মাল স্ক্যানার মেশিন বসানো হয়। তিনটি মেশিনের মধ্যে একটি ভিআইপি জোনে, বাকি দুটি সাধারণ যাত্রীদের যাতায়াতের স্থানে বসানো হয়েছে। তবে বিভিন্ন সময়ে এই থার্মাল স্ক্যানারগুলো বিকল হয়ে পড়ে।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এএইচএম তৌহিদ-উল আহসান বলেন, ‘যাত্রীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার কাজটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্বাস্থ্য বিভাগ করে থাকে। আমরা তাদের সহায়তা করি।’
এদিকে দেখা গেছে, হেলথ জোনে দায়িত্বরত চিকিৎসক ও নার্সদের মধ্যে কেউ কেউ হ্যান্ড গ্লাভস ছাড়াই যাত্রীদের সংস্পর্শে এসে তাপমাত্রা পরীক্ষা করছেন। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের করোনা ভাইরাস আক্রান্তদের শনাক্তের সময় সুরক্ষা ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
শাহজালাল বিমানবন্দর স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দুটি অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে, কোভিড-১৯ এর জন্য আরও একটি অ্যাম্বুলেন্স যুক্ত হয়েছে সেখানে। এসব অ্যাম্বুলেন্স পরিচালনার জন্য পাঁচ জন গাড়িচালক নিয়োজিত আছেন। বিমানবন্দর থেকে সন্দেহভাজনদের এসব অ্যাম্বুলেন্সে করেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে সেসময়ে গাড়িচালক ছাড়া কোনও ধরনের স্বাস্থ্যকর্মী সঙ্গে থাকেন না। একইসঙ্গে সন্দেহভাজনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরে অ্যাম্বুলেন্সটি জীবাণুমুক্ত (ডিজইনফেকশন) করণের কোনও ব্যবস্থাও নেওয়া হয় না। গাড়িচালকরা নিজ উদ্যোগে পরিচ্ছন্নতার কাজ করে থাকেন। তবে সেটা কতটা কার্যকর হয়, তা নিয়ে শঙ্কায় আছেন অ্যাম্বুলেন্স চালকরা।
ইউনিভার্সিটি অব টরোন্টোর সোশ্যাল অ্যান্ড রিহেভিয়ারাল হেলথ সায়েন্সের ডক্টরাল রিসার্চার শামীম আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাংলাদেশের বিমানবন্দরের চাইতেও স্থল ও নৌবন্দরগুলো অধিক ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। কেননা, আমদানি-রফতানির জন্য এই বন্দরগুলোই বেশি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সুতরাং, বিমানবন্দরে নজরদারি জারি রাখার পাশাপাশি স্থল ও নৌবন্দরগুলোতে সরকারের অস্থায়ী মেডিক্যাল পোস্ট স্থাপন ও জরুরি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা উচিত।’