কেমন আছেন ভারতের রোহিঙ্গা শরণার্থীরা || পর্ব-৩ || ভয়ানক ডিটেনশন সেন্টার

    0
    527

    দিল্লির শাস্ত্রি নগর এবং ইন্দারলোক মেট্রো স্টেশন থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শাহজাদা বাগ। সেখানে এক সরু গলিতে চোখে পড়ে নড়বড়ে একটি ভবন। জানালাগুলো বন্ধ। বাইরে দৃশ্যমান কোনো বোর্ড নেই। ভবনটির নিরাপত্তায় রয়েছে একদল সশস্ত্র প্রহরী। এই ভবনের নাম দেওয়া হয়েছে ‘সেবা কেন্দ্র’।

    ভেতরে অজানা সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আটকে রাখা হয়েছে। এই রোহিঙ্গারা নিজ দেশে বৌদ্ধদের নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে পালিয়ে প্রতিবেশী ভারতে এসেছিলেন আশ্রয়ের খোঁজে। আমাল আখতার নামে এমনই একজন রোহিঙ্গা শরণার্থীর জীবনকাহিনী ইতঃপূর্বে আপনারা জেনেছেন। আখতারের মতোই অন্য রোহিঙ্গাদেরকেও মদনপুর খাদার এবং ভিকাশপুরি ক্যাম্প থেকে বিনা অপরাধে তুলে এনে ছুঁড়ে ফেলা হয় ডিটেনশন সেন্টারের অন্ধকার কক্ষে। এই সেন্টারে কতদিন থাকতে হবে, জানা নেই তাদের।

    ডিটেনশন সেন্টারের ভেতরের পরিস্থিতি জানা অসম্ভব। কারণ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ব্যতীত অন্য কেউ ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না। এমনকি আইনজীবী কিংবা মিডিয়াও পারে না। ভারত জুড়ে আনুমানিক ১০টি ডিটেনশন সেন্টার হয়েছে; এর মধ্যে দিল্লির এই ডিটেনশন সেন্টারটি একটি।

    আইনজীবীরা ডিটেনশন সেন্টারে বন্দী তাদের মক্কেলদের সাথে সাক্ষাতের জন্য ‘বিদেশি আঞ্চলিক নিবন্ধন অফিসে’ (FRRO) বারবার আবেদন জানিয়েছেন। কিন্তু প্রতিবারই নাকচ করা হয়েছে তাদের আবেদন।

    এভাবে কোনো তত্ত্বাবধান কিংবা আইনি সহায়তার অনুমতি না দিয়ে শরণার্থীদের প্রতি মানবিক আচরণের বহু আন্তর্জাতিক চুক্তির (যার অনেকগুলোতে ভারত সাক্ষরও করেছে) লঙ্ঘন করেছে ভারত। এমনকি আটক সংক্রান্ত ভারতের নিজস্ব নিয়ম এবং আইনও লঙ্ঘন করা হয়েছে। এক এফআরআরও (FRRO) কর্মকর্তা অনানুষ্ঠানিকভাবে বলেছে, বন্দীদের ‘প্রয়োজনীয় সকল সুবিধা’ দেওয়া হয়েছে। সেখানে আইনজীবীদের কোনো প্রয়োজন নেই।

    অথচ ডিটেনশন সেন্টার থেকে মুক্তি পাওয়া রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে ভিন্ন তথ্য। ডিটেনশন সেন্টারে বন্দী ছিলেন এমন পাঁচজন রোহিঙ্গা শরণার্থীর সাথে কথা বলেছি আমরা। তারা জানিয়েছেন, ধারণ ক্ষমতার চেয়েও অনেক বেশি মানুষকে রাখা হয়েছে ডিটেনশন সেন্টারে। সেখানকার পরিবেশ খুবই অস্বাস্থ্যকর। বন্দীদের প্রতি রুক্ষ আচরণ এবং গালিগালাজ নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। সঠিক চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থাও নেই সেখানে। আর বিনা পারিশ্রমিকে দিনের পর দিন কাজ করতে বাধ্য করা হয় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের।

    স্বাস্থ্যের চরম অবনতির কারণে ডিটেনশন সেন্টার থেকে মুক্তি পেয়েছেন কয়েকজন শরণার্থী। ডিটেনশন থেকে মুক্তি পেলেও ফিরে আসতে হয়েছে মদনপুর খাদার এবং ভিকাশপুরির সেই জীর্ণশীর্ণ শরণার্থী শিবিরে। সেখান থেকেই তারা নিজেদের ডিটেনশন সেন্টারের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন আমাদের কাছে।

    তারা বলেছেন, কক্ষগুলোতে ধারণ ক্ষমতার অধিক মানুষ রাখার কারণে ঘুমাতে কষ্ট হতো। গ্রিলের জানালাগুলো থাকতো বন্ধ। কার্ডবোর্ড দিয়ে ঢেকে রাখা হতো এগুলো। সূর্যের আলো পৌঁছারও কোনো উপায় ছিল না। এমনকি কখন দিন, কখন রাত—এটা বুঝতেও কষ্ট হতো আমাদের।

    পুরুষ ও নারীদের জন্য পৃথক বাসস্থান থাকলেও খাবার কক্ষ ছিল একটি। সেটিও খুবই ছোট। ডিটেনশন সেন্টার ভবনের পাশাপাশি নোংরা টয়লেটও পরিষ্কার করতে হতো তাদের। পাশাপাশি সহ্য করতে করতে হতো হিন্দুত্ববাদী কর্মকর্তাদের অপমান।

    প্রতি রাতে ৭টা থেকে ১০টার মধ্যে কক্ষগুলো বন্ধ করে দেওয়া হতো, কেবল মাঝ রাতে একবার খুলে দেওয়া হতো টয়লেট ব্যবহারের জন্য। কয়েকজন বন্দীর প্রস্রাবে সমস্যা ছিল। তাদের টয়লেট ব্যবহারের প্রয়োজন হলে চিৎকার করে বলতে হতো। আর মহিলা এবং শিশুরা প্রায়ই রুমের মধ্যেই প্রাকৃতিক প্রয়োজন সারতে বাধ্য হতেন।

    ১৯ বছর বয়সী রোহিঙ্গা শরণার্থী ফারজানা রেহমান। এত অল্প বয়সেই চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেছে তার, শরীরের অবস্থা খুবই দুর্বল। এমনকি অন্য কারো সাহায্য ছাড়া হাঁটতেও পারেন না। ১৫ মাস ডিটেনশন সেন্টারে ছিলেন তিনি। এরপর থেকেই তার এই অবস্থা। এই বয়সেই বেশ কয়েকবার চিকিৎসা জটিলতার মুখোমুখি হয়েছেন, এমনকি সাময়িকভাবে প্যারালাইসিসেও আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি।

    ডিটেনশন সেন্টারে কাটানো সময়গুলোর কথা মনে পড়তেই উদ্বেগে কণ্ঠ কেঁপে উঠলো ফারজানা রেহমানের।

    [চলবে ইনশাআল্লাহ…]

    অনুবাদ: সাইফুল ইসলাম


    কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ ভারতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের হালাত নিয়ে তৈরি “Rohingya Refugees Recall Desperate Conditions With No Legal Recourse In Delhi Detention Centre” এই শিরোনামে article14 এ প্রকাশিত প্রতিবেদনটি আমরা ধারাবাহিক ভাবে বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশ করছি।


    তথ্যসূত্রঃ
    1. Rohingya Refugees Recall Desperate Conditions With No Legal Recourse In Delhi Detention Centre – https://tinyurl.com/yvxps73w


    আগের পর্বগুলো পড়ুনঃ

    কেমন আছেন ভারতের রোহিঙ্গা শরণার্থীরা ||পর্ব-১ || এক রোহিঙ্গা নারীর আত্মকাহিনী

    কেমন আছেন ভারতের রোহিঙ্গা শরণার্থীরা || পর্ব-২ || রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি দেবে না ভারত

    মন্তব্য করুন

    দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
    দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

    পূর্ববর্তী নিবন্ধতালিবান গোয়েন্দা সংস্থা GDI: বিশ্বপটে নয়া ধামাকা!
    পরবর্তী নিবন্ধকাশ্মীরে ভারতের আগ্রাসনঃ এক মাসে ১৯৫ অভিযান, ১৪ মুসলিম খুন