৪৭ এর কাশ্মীর গণহত্যা: হিন্দুত্ববাদী ভারতের আসল চেহারা

0
527

১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হবার সময় উগ্র হিন্দুরা কাশ্মীরের মুসলিমদের ওপর চালায় মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বর গণহত্যা। তৎকালীন হিন্দুত্ববাদী ডোগরা মহারাজা হরি সিং এর বাহিনী ও উগ্র শিখরা এই গণহত্যা চালিয়েছিল। আর হিন্দুত্ববাদী আরএসএস (রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ) এর কর্মীরা গণহত্যার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল।

সে বছর অক্টোবর ও নভেম্বর – মাত্র দুই মাসে প্রায় ২ লাখ ৩৭ হাজার কাশ্মীরি মুসলিমকে হত্যা করেছে উগ্র হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীরা। মুসলিমদেরকে সমূলে কাশ্মীর ছাড়া করতে তাদেরকে তাড়িয়ে দেয়া হয় বর্তমান পাকিস্তান। এতে বাস্তুচ্যুত হয়েছিল প্রায় পাঁচ লাখ কাশ্মীরি মুসলিম।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তানগামী একদল বাস্তুচ্যুত কাশ্মীরী। ফাইল ছবি।

১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট দেশ ভাগ হবার পর থেকেই কাশ্মীরকে মুসলিম শুন্য করার ষড়যন্ত্র শুরু করে হিন্দুত্ববাদীরা। মহারাজা হরি সিং এর ভয় ছিল, কাশ্মীর মুসলিম অধ্যুষিত হওয়ায় ভবিষ্যতে সে ক্ষমতাচ্যুত হতে পারে। এজন্য কাশ্মীরকে কুক্ষিগত করে রাখতেই এই নির্মম গণহত্যা ও জাতিগত নির্মূলকরণের পদক্ষেপ নিয়েছিল সে।

দেশ ভাগের মাত্র দু’মাস যেতে না যেতেই অক্টোবরের মাঝামাঝিতে উগ্র হিন্দুত্ববাদী আরএসএস সদস্যরা কাশ্মীরের বিভিন্ন জেলায় আক্রমণ করে। মুসলিমদেরকে হত্যা ও মুসলিমদের সম্পত্তি লুটপাট, বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে শুরু করে গণহত্যার সূচনা। মহারাজা হরি সিং এর হিন্দুত্ববাদী বাহিনী এসব হামলায় দাঙ্গাকারীদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করে। এর আগে, হরি সিং তার রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনী থেকে সকল মুসলিম সৈন্য ও পুলিশ অফিসারদের বরখাস্ত করে।

মুসলিম গণহত্যাকে সহজ করতে হরি সিং এর বাহিনী কাশ্মীরে কারফিউ জারি করে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে টহল দিত। এমন চতুর্মূখী সংকটে লক্ষ লক্ষ কাশ্মীরী ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে পাকিস্তান ও আশে পাশের এলাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিল। পথিমধ্যেও তাদেরকে নৃশংসভাবে হত্যা করে বর্বর উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা। বলা হয় যে, রামনগরে মুসলিম নারী, পুরুষ এবং শিশুদের মৃতদেহগুলো এক বিশালাকার স্তুপে পরিণত হয়েছিল।

গণহত্যার পর স্তুপ করে রাখা কাশ্মীরী মুসলিমদের লাশ। ফাইল ছবি।

শুধু তাই নয়, জম্মু শহরের মুসলিম এলাকাগুলো অবরোধ করে খাবার ও পানি সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিল মুসলিম বিদ্বেষী সন্ত্রাসী হরি সিং। তালাব খতিকান এলাকার মুসলিমরা নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য হরি সিংয়ের বাহিনীর কাছে আবেদন জানায় যে, তারা নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে শিয়ালকোটে (পাকিস্তান) চলে যেতে চান। হরি সিংয়ের বাহিনী তাদের অনুমতি দিলে লাখ লাখ মুসলিম পাকিস্তানের শিয়ালকোটের দিকে যেতে থাকে। কিন্তু গাদ্দার হিন্দুত্ববাদী শিখ এবং আরএসএস এর সশস্ত্র সদস্যরা পথিমধ্যে তাদেরকে অবরোধ করে। মুসলিমদেরকে গাড়ি থেকে টেনে-হিছড়ে বের করে গণ হারে হত্যা করতে থাকে। সেদিন অগণিত মুসলিম নারীদের ধর্ষণ করে এই হিন্দুত্ববাদী উগ্র সন্ত্রাসীরা।

এর বাইরে, উধমপুর, চেনানি, রামনগর, ভাদেরওয়াহ, রিয়াসি ছাম্ব, দেবা বাটালা, মানাওসার, আখনুর, কাঠুয়া ও বিল্লাওয়ার এলাকাতেও গণ হারে মুসলিমদের হত্যা করে ও মুসলিম নারীদের ধর্ষণ করে নাপাক উগ্র হিন্দুরা।

 

গণহত্যার শিকার কিছু মুসলিম। ফাইল ছবি।

কাশ্মীরে ১৯৪৭ সাল থেকে যে গণহত্যা শুরু হয়েছে তা এখনো চলমান। বরং বর্তমান সময়ের হিন্দুত্ববাদীরা উগ্রতায় তাদের উত্তরসূরীদের থেকে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে। কিছুদিন আগে ভারতীয় সংবিধানের ৩৫-ক এবং ৩৭০ ধারা বাতিল করে কাশ্মীরের স্বায়ত্ব শাসন ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে হিন্দুত্ববাদী ভারত। তারপর শুরু করেছে নতুন উদ্দমে গণহত্যা। কাশ্মীরে সাত লাখেরও বেশি হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় সেনাবাহিনী মোতায়েন করে গুম, খুন, গ্রেফতার ও মুসলিম নারীদের ধর্ষণ এখন সেখানকার নিত্যনৈমত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কাশ্মীরী মুসলিমদের ওপর যুগ যুগ ধরে দখলদার হিন্দুত্ববাদীরা ইতিহাসের বর্বোরচিত গণহত্যা চালালেও এখন পর্যন্ত কেউই ভারতের বিরুদ্ধে কেউই কোন পদক্ষেপ নেয়নি। বরং এই গণহত্যাকে বিশ্ববাসীর কাছ থেকে আড়াল করে রেখেছে সবাই।

কথিত জাতিসংঘ নামক মুসলিম বিরোধী সংস্থাটি তুচ্ছ অযুহাতে ইন্দোনেশিয়ার পূর্ব তিমুরকে আলাদা খ্রিষ্টান রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা হতে না হতেই পশ্চিমা দেশগুলোকে একত্রিত করে রাশিয়ার বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছে। অথচ যুগ যুগ ধরে কাশ্মীর, আরাকান, ফিলিস্তিনে দখলদারদের বিরুদ্ধে কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি।

এদিকে বর্তমান ভারতে নতুন করে মুসলিমদের ওপর গণহত্যার আশংকা জানিয়ে সতর্কবার্তা দিয়েছেন আন্তর্জাতিক গণহত্যা বিশেষজ্ঞরা। সাম্প্রতিক সময়ে শুধু কাশ্মীর নয়, পুরো ভারতেই মুসলিমদের ওপর নির্যাতন ও মুসলিম বিদ্বেষ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। যেকোন সময় তা ভয়াবহ আকারের গণহত্যায় রুপ নিতে পারে।

এ অবস্থায় মুসলিমদের উচিৎ এখন থেকেই প্রস্তুতি শুরু করা; নিজেদের মধ্যে ভেদাভেদ ভুলে একে অপরের ভাই হয়ে যাওয়া। অন্যথায় আসন্ন বিপদের সময় হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীদের মোকাবেলায় মুসলিমরা কাউকেই পাশে পাবে না। যেমনটা ঘটেছে আরাকান, ফিলিস্তিনসহ মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে। সুতরাং, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হওয়া এখন সময়ের দাবি।


লেখক: মুহাম্মাদ ইব্রাহীম


তথ্যসূত্র:

১। The forgotten massacre that ignited the Kashmir dispute – https://tinyurl.com/y25yj5ad

২। 1947 Jammu massacres – https://tinyurl.com/yndaz9ee

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধজাইশুল-আদল: ইরানি শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধই মুক্তির একমাত্র উপায়
পরবর্তী নিবন্ধগণহত্যার প্রস্তুতি || ৬০ লাখ কর্মী নিচ্ছে উগ্র হিন্দু সংগঠনগুলো