কথিত ভালোবাসা দিবসের ‘ভালোবাসা’ ও ঈমানদারের প্রকৃত ভালোবাসা

0
1038
প্রথম কিছু কথা:

কথিত ভালোবাসা দিবস সম্পর্কে বা এর কুফল ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা-আর্টিকেল অনেক পড়া-শোনা হয়েছে আমাদের। তবে অশ্লীলতার স্বাভাবিকিকরণের প্রবল স্রোতে হয়তো সেগুলো সঠিক প্রভাব ধরে রাখতে পারেনি যুবসমাজের মননে।

আজ তাই আমরা কথিত এই প্রেম-ভালোবাসা ও কথিত “ভালোবাসা দিবসের” আলোচনার আরেকটু গভীরে যেতে চাই; নিজেদের ও জাতির অবস্থান আরেকটু স্পষ্টভাবে জেনে সংশোধনের প্রয়াস নিতে চাই। কেননা সমস্যা সমাধানের প্রথম ধাপ হচ্ছে সমস্যাকে স্বীকার করা ও চিহ্নিত করা, তার পরেই কেবল সমাধানের প্রসঙ্গ আসে।

ভালোবাসা দিবস ও কথিত প্রেম-ভালোবাসার বিবর্তন:

কথিত ভালোবাসা দিবস বা প্রেম-ভালোবাসা, বিষয়গুলো একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্য সমাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এমনকি একসময় খোদ পাশ্চাত্য খ্রিস্টান জগতেও এই কথিত ভালোবাসা দিবস পালন নিষিদ্ধ ছিল। প্রাচীন রোমে ১৪ ফেব্রুয়ারি ছিল রোমান দেবী রানী জুনোর সম্মানে ছুটির দিন। জুনোকে নারী ও প্রেমের দেবী বলে লোকে বিশ্বাস করত, আর কারো কারো মতে ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবস হওয়ার কারণ ছিল এটিই। তাছাড়া পাশ্চাত্যের মানুষদের ক্ষেত্রে ধর্মীয় উৎসব থেকে শুরু করে সকল উৎসবেই ছিল শুধু ভোগবাদিতা, সর্বক্ষেত্রেই ভোগের বিষয়টি তাদের কাছে মুখ্য। ফলশ্রুতিতে গির্জার অভ্যন্তরেও এই দিবসে তারা মদ্যপানে তারা বিরত থাকে না। তাই ভ্যালেন্টাইন দিবসের কারণে  খ্রিস্টীয় চেতনা বিনষ্ট হওয়ার অভিযোগে ১৭৭৬ সালে ফ্রান্স সরকার এই উৎসব নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ইংল্যান্ডে ক্ষমতাসীন পিউরিটানরাও একসময় প্রশাসনিকভাবে এ দিবস উদযাপন নিষিদ্ধ করেছিল। এছাড়া অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি ও জার্মানিতে বিভিন্ন সময়ে এ দিবসটি জনগণ ও সরকারিভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল।

এই কথিত ‘ভালোবাসা দিবস’ বা ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ প্রচলনের আরও কিছু কাহিনী প্রচলিত আছে, যা কম-বেশি প্রায় সবারই জানা। রোমে সম্রাট ক্লডিয়াসের যুগে কথিত খ্রিস্টান পাদ্রি ভ্যালেন্টাইন কর্তৃক এক অন্ধ মেয়েকে লেখা “ইতি তোমার ভ্যালেন্টাইন (From your Valentine)” লিখা চিরকুট দেখিয়ে অবৈধ আবেগকে নিঃস্বার্থ প্রমাণের চেষ্টার মাধ্যমেই প্রেম-ভালোবাসার অন্ধকার ঘরে যুবক-যুবতিদের টেনে আনার শুরুটা হয়েছিল। আবার সম্রাটের বিয়ে নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও আত্মত্যাগের কাহিনীও শোনা যায়। ভালোবাসার এসব কথিত ‘কীর্তির’ জন্য ৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে পোপ জেলাসিয়ুস ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখকে ভ্যালেন্টাইন্স ডে হিসেবে ঘোষণা করেন। সেই থেকে পাশ্চাত্য জগতে এই দিনটিকে ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ হিসেবে পালনের প্রচলন শুরু।

বর্তমান যুগে যখন থেকে ভোগবাদিতা ও ব্যক্তিস্বাধীনতাকে ঘিরে পশ্চিমা সভ্যতা ও বিশ্বসভ্যতা বিকশিত হতে থাকে, তখন থেকেই এই ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ ও প্রেম-ভালোবাসার নামে অশ্লীলতাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হতে থাকে। কর্পোরেট জগত, মিডিয়া এবং কথিত প্রগতিবাদী বুদ্ধিজীবীমহল এক হয়ে মানবজাতিকে ভোগবাদিতার চরম উৎকর্ষ অর্জনের প্রতিযোগিতায় নামিয়ে সবাইকে নিজেদের গোলাম বানাতে শুরু করে। তখন তাদের আগেকার প্রচারিত প্রেম-ভালোবাসার স্বর্গীয় অনুভূতি শারীরিক কামনা-বাসনার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যেতে থাকে।

যুবক-যুবতিদেরকে প্রথমে ‘স্বর্গীয় পবিত্র ভালোবাসা’র কাল্পনিক মোহে আচ্ছন্ন করে অশ্লীলতার দরজাটি খুলে নেয়া হয়। পরে সেই দরজায় ঢুকে ভোগবাদের অথৈ সলিলে গা ভাসিয়ে যুবক-যুবতিরা নিজেদের সতীত্ব বিসর্জন দিয়ে হলেও আকাঙ্ক্ষার চূড়ান্ত তুষ্টি অর্জনের নেশায় মত্ত হতে থাকে; শুরু হয় জেনা-ব্যভিচারের এক অগাধ জোয়ার। এই জোয়ার কেবল পাশ্চাত্যেই থেমে না থেকে প্রাচ্য ও মুসলিম দুনিয়াকেও গ্রাস করে নিতে থাকে ধীরে ধীরে।

৯০ ও এর পরবর্তী দশকে জুড়ে গান-নাটক-সিনেমাগুলোতে কথিত স্বর্গীয় “পবিত্র প্রেমের” শ্লোগান প্রচার করা হতে থাকলে, সমাজে তা ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে যখন নাটক-সিনেমাতে ‘ভুলবশত’ অবৈধ শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়াকে নায়ক-নায়িকার “অনিচ্ছাকৃত ভুল” হিসেবে চিত্রিত করা হতে থাকে, সমাজেও তখন পালা দিয়ে এই “ভুলের” চর্চা বাড়তে থাকে। এভাবে আসতে আসতে জল গরাতে গরাতে নাটক-সিনেমা এখন যুগলদের অবৈধ শারীরিক সম্পর্ককে একটি স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে তুলে ধরছে; সমাজেও তাই এখন অবৈধ প্রেম-ভালোবাসা অবৈধ শারীরিক সম্পর্কে রূপ নিয়েছে।

আর সর্বশেষ এখন চলছে বহুগামিতাকে স্বাভাবিকিকরণের ‘ট্রেন্ড’।

পাশ্চাত্য জগত অবশ্য এসব স্তর অনেক আগেই পার করে এসে এখন সমকামিতা ও উভগামিতার যুগে প্রবেশ করেছে। এমনকি শিশুগামিতা ও পশুগামিতাকেও এখন প্রমোট করতে শুরু করেছে নিকৃষ্ট পশ্চিমারা। নাউজুবিল্লাহ। তাদের সমাজেও এখন তাই পরিবার প্রথা বিলুপ্ত হয়ে সিঙ্গেল প্যারেন্টহুডের স্তরে অবনমিত হয়ে গেছে। এমনকি পশ্চিমারা এখন বিয়ে-সন্তান-পরিবার এগুলোকে বোঝা মনে করে নিজেদেরকে অবাধ যৌনতার নিমেষ আঁধারে ছুঁড়ে দিয়েছে।

এভাবেই কথিত প্রেম-ভালোবাসার ধারাবাহিক বিবর্তন মানব সমাজকে আজ পশুসমাজে পরিণত করেছে। আর প্রেম-ভালোবাসার এই ধারাবাহিক বিবর্তনের পেছনে ‘অনবদ্য’ ভূমিকা রেখে গেছে এই কথিত ‘ভালোবাসা দিবস’। এই দিবসের উসিলাতেই যুবক-যুবতিদের আবেগ-চাহিদা উস্কে দিয়ে প্রগতি আর ভোগবাদ জায়গা করে নিয়েছে মুসলিম দেশগুলোতেও। এই দিবসের উসিলায় নানা জায়গায় চলে গান-বাজনার উন্মত্ত কন্সার্ট, পার্টির নামে চলে মদ্যপান ও প্রকাশ্য অশ্লীলতা। সমাজে পচন ধরিয়ে দিয়েছে ভালোবাসা দিবসের এই চতুর্মুখী প্রভাব, নবজাতকদের আজ খুঁজে পাওয়া যায় ডাস্টবিনে!

ভ্যালেন্টাইন্স ডের উৎপত্তির বিষয়ে আরও কয়েকটি সম্পূর্ণ আলাদা মত রয়েছে।
প্রাচীনকালে পসচিমা জগতের মানুষের বিশ্বাস ছিল, ১৪ ফেব্রুয়ারি হল পাখিদের বিয়ের দিন। পাখিরা বছরের দ্বিতীয় মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ডিম পাড়তে বসে। আবার কেউ বলেন, মধ্যযুগের শেষদিকে পশ্চিমা জগতের মানুষ বিশ্বাস করতো, এদিন থেকে পাখিদের মিলন ঋতু শুরু হয়, পাখিরা সঙ্গী খুঁজে বেড়ায়। পাখিদের দেখাদেখি মানুষও তাই সঙ্গী নির্বাচন করে এ দিনে।
মানুষকে পশু-পাখির স্তরে নামিয়ে আনার কি নিকৃষ্ট এক আয়োজন!

অবাধ অশ্লীলতার কালিমার বিবরণে ক্লান্ত হয় ওঠা আমাদের দৃষ্টি এবার আমরা ঘুরাতে চাই ঈমানদারের প্রকৃত ভালোবাসায় :

ইসলাম আল্লাহ্‌ তাআলা মনোনীত একমাত্র হক্ক জীবনবিধান। মানবজীবনের প্রতিটি স্তরের প্রতিটি ক্ষেত্রের প্রয়োজনীয় হুকুম-আহকাম ইসলামে বর্ণিত রয়েছে। আল্লাহ্‌ তাআলা প্রদত্ত এই জীবনবিধানে অবাধ ব্যক্তিস্বাধীনতা কিংবা নফসের চরম চাহিদা-পূরণের কোন সুযোগ নেই; সবই হবে সিমিত পরিসরে- ব্যক্তি সমাজ ও মানবতার সর্বাঙ্গীণ কল্যাণের কথা মাথায় রেখে। এখানে ব্যক্তিস্বাধীনতা, মানবিক চাহিদাপূরণ সবকিছুই হবে আল্লাহ্‌ তাআলা প্রদত্ত পবিত্রতার সীমারেখার মধ্যে থেকেই।

কিন্তু বস্তুবাদী নফসপূজারিরা প্রেম-ভালোবাসার নামে আর কথিত এই ভালোবাসা দিবসের মিথ্যা ভালোবাসার নামে খাহেসাতের যে চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে, সার্বিকভাবে এই চর্চা সমাজকে অধঃপতনের তলানিতে নিয়ে যাচ্ছে। তারা হার্ম প্রিন্সিপালের (আমি যা খুশি করবো কারো কোন ক্ষতি না করে) খোঁড়াযুক্তি দাঁড় করিয়ে এই বাস্তবতা এড়িয়ে যেতে চায় যে, সমাজে এসব অশ্লীলতার চর্চা ব্যাপক করার মাধ্যমে মানবতার সর্বাঙ্গীণ ক্ষতি হচ্ছে। এসব অশ্লীলতা, বেহায়াপনা এবং অবৈধ প্রেম-ভালোবাসা সমাজে ছড়িয়ে পরার মাধ্যমে অবৈধ গর্ভধারণ ও তালাক বেড়ে যাচ্ছে, পারিবারিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে, মানুষ পরিবার ও সমাজবদ্ধ জীবনের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে, এভাবে ভেঙে পড়ছে সামাজিক শৃঙ্খলা। মানুষ পরিণত হচ্ছে পশুতে আর সমাজ পরিণত হচ্ছে পশু সমাজে।

কেউ কারো ধার ধারছে না। পিতা-মাতা সন্তান লালন-পালনকে বোঝা মনে করছে। সন্তান বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে ফেলে আসছে। আত্মহত্যা ও সামাজিক অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে, নেশা ও মাদকাসক্তি বেড়ে যাচ্ছে, পরকিয়ায় জড়িয়ে হত্যা ও ধর্ষণের মতো অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে, এমনকি পিতা-মাতা হত্যা করছে নিজ সন্তানকে। সূক্ষ্মদর্শী ব্যক্তি মাত্রই একমত হবেন যে, এই সবগুলো বিষয় একটি অপরটির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

ভালোবাসা দিবসের কথিত ভালোবাসা ও অবৈধ সম্পর্ক আমাদেরকে এমন সমাজই উপহার দিয়েছে আজ; চারিদিকে শুধু ধ্বংস আর ধ্বংস।

দিগ্বিজয়ী মুসলিম বীর সালাহ্‌-আদ্‌-দ্বীন আইয়ুবি (রহিমাহুল্লাহ) অনেকটা এমন বলেছিলেন যে, কোন জাতিকে যুদ্ধ ছাড়াই ধ্বংস করে দেওয়ার উপায় হল যুবসমাজের মধ্যে অশ্লীলতা ব্যাপক করে দেওয়া।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এমনই পশুসমাজের অন্ধকারে নিমজ্জিত করে রেখে যেতে চাই?
নাকি কথিত প্রেম-ভালোবাসা বা ভালোবাসা দিবসে ‘কাছে আসার সাহসী গল্প’ থেকে দূরে সরিয়ে একটি সুস্থ মানবিক সমাজে রেখে যেতে চাই?

আগে চলুন দেখে নেয়া যাক কথিত প্রগতিশীল আর ব্যক্তিস্বাধীনতার নামে নফসের পূজারিদের অবৈধ প্রেম-ভালোবাসাময় পশু সমাজের বিপরীতে ইসলাম আমাদেরকে কি বিকল্প প্রস্তাব করছে।

ইসলাম আমাদেরকে পারিবারিক ও আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করতে শেখায়, পিতা-মাতার আনুগত্য করতে শেখায়, আর স্ত্রী-সন্তান এমনকি পাড়া-প্রতিবেশীদের হক্ক আদায় করতে শেখায়। ইসলাম আমাদেরকে আরও শিখায় জীবে দয়া করতে এবং সকল মানুষের সাথে উত্তম আচরণ করতে। আর এভাবে পরস্পরের প্রতি দায়িত্ব পালন, উত্তম আচরণ ও ব্যক্তিস্বার্থে ছাড় দেওয়ার মাধ্যমে আল্লাহ্‌ তাআলা পরস্পরের অন্তরে পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা তৈরি করে দেন; যে ভালোবাসা হক্কের পথে একে অন্যের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে শেখায়।
ইসলাম আমাদেরকে এটাও শেখায় যে, ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ হবে আল্লাহ্‌ তাআলার নির্ধারিত পবিত্রতার সীমার মধ্যে থেকেই।

এসবই আল্লাহ্‌ তাআলা ও তাঁর রাসুলের (সাঃ) নির্দেশ, যা আমাদের জন্য অবশ্য পালনীয়। দুনিয়ার জীবনের এই সংক্ষিপ্ত সময়ে আমরা আমাদের নফসকে নিয়ন্ত্রণ করে আল্লাহ্‌ তাআলার নির্ধারিত সীমারেখার মধ্যে থেকে জীবন পার করতে পারলে, মৃত্যু-পরবর্তী অনন্ত জীবনে আল্লাহ্‌ তাআলা আমাদের দান করবেন তাঁর ক্ষমা ও সুমহান জান্নাত; এমন এক জান্নাত যার প্রস্থ আসমান থেকে জমিন সমান। সেখানে মানুষের চরম আকাঙ্ক্ষিত সকল বস্তুই আল্লাহ্‌ তাআলা মজুদ করে রেখেছেন তাদের জন্য- যারা দুনিয়ার এই সংক্ষিপ্ত সময়ে আল্লাহ্‌ তাআলার ভালবাসায় তাঁর নির্ধারিত সীমারেখা সংরক্ষণ করে চলেছে।

তবে বস্তুবাদীরা এসব নিয়ে উপহাস করে; তারা ভোগের চরম উৎকর্ষতাকেই জীবনের পরম লক্ষ্য বানিয়ে নিয়েছে। সমাজের সার্বিক মঙ্গলের জন্য আল্লাহ্‌র নির্দেশে নিজেদের চাহিদা-কামনা-বাসনাকে দমন ও নিয়ন্ত্রণকে তারা পশ্চাৎপদতা ও মূর্খতা সাব্যস্ত করে। কেবলমাত্র বস্তুগত উৎকর্ষ সাধন ও ভোগের চরম বহিঃপ্রকাশের স্বাধীনতাকেই তারা প্রগতি আর উন্নয়ন বলে সংজ্ঞায়িত করে, যদিও তাদের মনগড়া এসব সংজ্ঞা সমাজকে ধ্বংসের অতল গহ্বরে নিয়ে যাক না কেন!

কিন্তু তাদেরকে যদি প্রশ্ন করা হয়, আপনাদের এসব রীতি-নীতি আর মনগড়া ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণই যে একমাত্র সঠিক, এটা আপনারা কিসের ভিত্তিতে নির্ধারণ করলেন? কিংবা তাদেরকে যদি প্রশ্ন করা হয়- জগৎসমূহের স্রষ্টা মহাজ্ঞানী আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামিনের প্রদত্ত ওহীভিত্তিক ব্যবস্থাপনাকে কোন জ্ঞানের ভিত্তিতে আপনারা পশ্চাৎপদ সাব্যস্ত করছেন? – এসকল প্রশ্নের সঠিক কোন উত্তর তাদের কাছে নেই। কারণ তাদের ভাল-মন্দ নির্ধারণের শক্তিশালী কোন মানদণ্ড বা ভিত্তি নেই; বস্তুবাদিতা আর কথিত প্রগতির সকল তত্ত্বকথাই তাদের মনগড়া, নফস আর খাহেসাত থেকে উদগত।

সুতরাং এসব ভিত্তিহীন তত্ত্বকথা ছুঁড়ে ফেলে আমাদেরকে মহাজ্ঞানী, সর্বশক্তিমান মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ্‌ তাআলার ভালবাসায় ফিরে আসতে হবে; দেশ, সমাজ, পরিবার ও ব্যক্তিজীবন সবই পরিচালিত করতে হবে তাঁর কল্যাণময় নির্দেশের ভিত্তিতে, অন্য কিছুর মাধ্যমে নয়।

আর আমাদের ভালোবাসাও হবে কেবলমাত্র তাঁরই জন্যে; আমরা পিতা-মাতাকে ভালোবাসবো, স্ত্রী-সন্তানকে ভালোবাসবো, ভাই-বোন ও আত্মীয়-স্বজনের হক্ক আদায় করবো তাঁর ভালোবাসায় উদ্বেলিত হয়ে, তাঁরই সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে। তবে আমরা আমাদের পিতা-মাতা, আমাদের স্ত্রী-সন্তান, ভাই-বোন, আমাদের বংশ-গোত্র, আমাদের ব্যবসা ও মালসম্পদ এবং আমাদের বাসগৃহকে কখনোই আল্লাহ্‌, তাঁর রাসুল (ﷺ) এবং আল্লাহ্‌র পথে জিহাদ করার চেয়ে বেশি ভালবাসিনা। আর এমনটা করলে তো আমরা আমাদের আহলদের সাথে পরকালের সুখময় অনন্তজীবন উপভোগ করতে পারবো না। তাই, আমাদের ভালবাসা ও ঘৃণা কেবলমাত্র তাঁর জন্যেই নির্ধারিত হবে। রব্বে করিমের ভালবাসায় আমরা আমাদের নফসকে কুরবান করবো, তাঁর দর্শন লাভের পরম আকাঙ্ক্ষায় আমরা সহাস্যে আমাদের জীবন পর্যন্ত কুরবান করে দিব। আমাদের সলাত, কুরবানি, আমাদের জীবন ও মরণ সবই হবে তাঁর জন্য।

একটু ভেবে দেখুন, আপনি যখন আপনার রবের ভালবাসায় পবিত্র অন্তর নিয়ে হাজির হবেন, আপনি যখন আপনার রবের উপস্থিতি ও সন্তুষ্টি- অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করতে পারবেন, মহা বিশ্বের মহান রব্ব আপনার ডাকে সারা দিচ্ছেন- এমন অনুভূতি যখন আপনার অন্তরে দোলা দিয়ে যাবে, এর চেয়ে পরম সুখ আর পরম আনন্দানুভূতি একজন সাধারণ মানুষের জন্য আর কি হতে পারে!

এটাই আমাদের ভালোবাসা, মুমিন হৃদয়ের বাসনা; আমাদের স্বপ্ন ও কল্পনা, আমাদের যাবতীয় চাওয়া-পাওয়া-ভালোবাসা আমাদের রবের সন্তুষ্টি ও ভালোবাসাকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। আমরা তাঁরই জন্য পিতা-মাতার খেদমত করি, তাঁরই জন্য স্ত্রী-সন্তান আর ভাই-বোনদের দেখভাল করি; আবার তাঁর জন্যই আমরা ঘরছাড়া দেশত্যাগী হই। আমরা তাঁর ভালোবাসাতেই বাঁচি আর তাঁর ভালবাসাতেই মরি। মৃত্যুর পর আমরা তাঁর সন্তুষ্টি, তাঁর দিদার ও তাঁর পুরষ্কারের আশা করি।

প্রশ্ন করুন, পশু সমাজের আহবানকারীরা আর তাদের মস্তিস্কপ্রসূত ভালবাসা দিবসের অবৈধ ‘প্রেম-ভালোবাসা’ ও ব্যক্তিস্বাধীনতার নামে নফসের পূজা- এগুলো কি অনন্তকালের পরম সুখ-সাচ্ছন্দ আর মহানুভবের মহাসান্নিধ্যের নিশ্চয়তা দিতে সক্ষম? কস্মিনকালেও না!
তাদের সাময়িক সুখানুভূতি তো নেশার এক দমেই উবে যায়, অবৈধ উপায়ে জন্ম নেওয়া প্রতিটি নিষ্পাপ শিশুর সাথেই তাদের কথিত ভালোবাসা আর প্রগতির কবর রচিত হয়ে যায়।

চলুন, আমরা সাহস করে সত্যকে দেখি, সত্যকে উপলব্ধি করি, মিথ্যাকে বর্জন করি। আঁকড়ে ধরি সেই করুণাময় রবের ভালোবাসাকে, যিনি আমাদের জীবনের গোপন-প্রকাশ্য শত পাপের পরেও আমাদেরকে ক্ষমা করে দিতে প্রস্তুত, আপনাকে-আমাকে নিজ ভালোবাসার চাঁদরে জড়িয়ে নিতে প্রস্তুত- কেবল একফোঁটা অনুতপ্ত অশ্রুর বিনিময়েই। যদিও আমার-আপনার ফিরে আশা বা না আশার প্রয়োজনের ঊর্ধ্বে তিনি।

বিনিময়হীন এই অগাধ ভালবাসা আমরা আমাদের রব্বে কারিমের সান্নিধ্য ছাড়া আর কোথায় পাব, বলুন!

 



লেখক : আব্দুল্লাহ বিন নজর

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধভারতে ‘ত্রিশূল দীক্ষার নামে অস্ত্র বিতরণ’, মুসলিম গণহত্যার একটি অশনি সংকেত
পরবর্তী নিবন্ধআল-ফিরদাউস নিউজ বুলেটিন || ফেব্রুয়ারি ২য় সপ্তাহ, ২০২৩ঈসায়ী