১৬ বছরে পাচার ১১ লাখ কোটি টাকা

0
2217
১৬ বছরে পাচার ১১ লাখ কোটি টাকা

অর্থপাচার থামছে না। আমদানি-রপ্তানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অঙ্কটি বড়ই হচ্ছে। গত ১৬ বছরে দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে অন্তত ১১ লাখ কোটি টাকা। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যানশিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। এই অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগও মুখ থুবড়ে পড়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, অর্থপাচারের প্রকৃত চিত্র আরো ভয়াবহ। বর্তমানে এমন অনেক খাতে অর্থপাচার হচ্ছে, যা জিএফআই আমলে নেয় না। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা প্রতিবেদন প্রকাশ করলে জাতীয় সংসদও সরগরম হয়ে ওঠে।

তর্ক-বিতর্কে একে অন্যকে দোষারোপ করতে দেখা যায়। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সব স্তিমিত হয়ে যায়। ওদিকে নীরবে চলতে থাকে বাণিজ্যের নামে অর্থপাচার।

ওদিকে চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য বিশ্লেষণ করে আমদানির কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে প্রতিবছর রেকর্ড গড়ার চিত্র দেখা যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় ওভার ইনভয়েস এবং আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অর্থপাচারের হারও অনেকখানি বেড়েছে।

জিএফআইয়ের তথ্যানুযায়ী, ২০০৫ সালে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৪২৬ কোটি মার্কিন ডলার। একই ধারায় ২০০৬ সালে ৩৩৭ কোটি, ২০০৭ সালে ৪০৯ কোটি, ২০০৮ সালে ৬৪৪ কোটি, ২০০৯ সালে ৫১০ কোটি, ২০১০ সালে ৫৪০ কোটি, ২০১১ সালে ৫৯২ কোটি, ২০১২ সালে ৭২২ কোটি, ২০১৩ সালে ৯৬৬ কোটি, ২০১৪ সালে ৯১১ কোটি এবং ২০১৫ সালে এক হাজার ১৫১ কোটি ডলার পাচার হয়। এরপর বাংলাদেশ থেকে আর কোনো তথ্য না পাওয়ার কথা জানিয়ে সংস্থাটি বলেছিল, বিগত বছরগুলোতে অর্থপাচারের ঘটনা অনেকাংশে বেড়েছে। আগের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ এবং অন্যান্য সংস্থার প্রতিবেদন আমলে নিয়ে সংস্থাটি জানিয়েছিল, বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে বছরে গড়ে ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যায়। সে হিসাবে ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে পাচার হয়েছে তিন লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রতিবেদন বলছে, প্রধানত ১০টি দেশ এই অর্থপাচারের বড় গন্তব্যস্থল। দেশগুলো হলো সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত, অস্ট্রেলিয়া, হংকং ও থাইল্যান্ড। আর পাচার চলছে মূলত বাণিজ্য কারসাজি ও হুন্ডির মাধ্যমে।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ১৬ বছরে যে পরিমাণ অর্থপাচারের কথা বলা হচ্ছে, তা সর্বশেষ দুই অর্থবছরের মোট বাজেটের কাছাকাছি। চলতি অর্থবছরের বাজেটের আকার ছয় লাখ তিন হাজার ৬৮১ কোটি এবং আগের অর্থবছরে বাজেট ছিল পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া পাচারের এই অর্থ দেশের বর্তমান জিডিপির ৩১ শতাংশ। বর্তমানে জিডিপির আকার ৩৫৫ বিলিয়ন ডলার। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার না হলে দেশে বর্তমানে জিডিপির আকার ছাড়িয়ে যেত সাড়ে চার শ বিলিয়ন ডলার।

অনেকে তুলনা করে বলছেন, পাচারের এই টাকা দিয়ে কয়েকটি পদ্মা সেতু বানানো যেত। সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্পের অন্যতম অংশ মেট্রো রেলই বা কতগুলো বানানো সম্ভব ছিল, এ হিসাবও কষছেন কেউ কেউ। উল্লেখ্য, পদ্মা সেতুর ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকা এবং মেট্রো রেল প্রকল্পের ব্যয় ২২ হাজার কোটি টাকা। পাচারের এই অর্থ দিয়ে দেশের বড় বড় মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন করা যেত খুব সহজেই।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানী সেলকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারে যে তথ্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো প্রকাশ করছে, সেটাও আংশিক। বাস্তবে পরিমাণ আরো অনেক বেশি। অনেক বিদেশি বাংলাদেশে কাজ করেন। তাঁরা আয়ের বড় একটা অংশ অবৈধভাবে বিদেশে পাঠান। এটাও অর্থপাচার। এই তথ্য কিন্তু বৈশ্বিক সংস্থাগুলো উল্লেখ করে না। তারা শুধু বাণিজ্যের আড়ালে অর্থপাচারের তথ্য দেয়। তিনি আরো বলেন, ‘যারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করা গেলে অর্থপাচার প্রতিরোধ ও ফেরত আনা যেত। এখানে আমাদের সদিচ্ছার ঘাটতি আছে।

৯৫ শতাংশ মামলা নিষ্পত্তি হয়নি : এদিকে পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার বিষয়ে মুখ থেকে মাঝেমধ্যে জোরালো বক্তব্য শোনা গেলেও তা বাস্তবায়ন হতে দেখা যায় না। আইনি জটিলতা, তদন্তে দীর্ঘসূত্রতা, আদালতে আসামিপক্ষের সময়ক্ষেপণ, সমন্বয়ের অভাব এবং উচ্চ আদালতে স্থগিতাদেশ থাকাসহ নানা জটিলতার কারণে পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনা যাচ্ছে না।

তবে অর্থপাচারের ৯৫ শতাংশ মামলাই নিষ্পত্তি হয়নি। মোট মামলার তিন-চতুর্থাংশই পারেনি নিম্ন আদালতের গণ্ডি পেরোতে। সুপ্রিম কোর্ট ও দুদকের তথ্য বলছে, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলার সংখ্যা ৪০৮, যার মধ্যে ১৮৭টি মামলা দুদকের। ৮৫টি মামলার বিচার চলছে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে। আর ঢাকায় ১০টি বিশেষ জজ আদালতে বিচারাধীন ১৮৫টি মামলা। এর মধ্যে হাইকোর্টের আদেশে ৫২টি মামলার বিচার কার্যক্রম স্থগিত আছে। আপিল শুনানির অপেক্ষায় আছে ২০টিরও কম মামলা। উচ্চ আদালতে মামলা নিষ্পত্তির সংখ্যাও ২০-এর বেশি নয়।

নিম্ন ও উচ্চ আদালতের তথ্য বলছে, পাচারের অভিযোগে রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো বছরের পর বছর ধরে বিচারাধীন। সাবেক মন্ত্রী ও বিএনপি নেতা ডক্টর খন্দকার মোশাররফ হোসেন, সাবেক এমপি বিএনপি নেতা হাফিজ ইব্রাহিম, যুবলীগের নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়া, ফারমার্স ব্যাংকের অডিট কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী, ডিআইজি প্রিজনস পার্থ গোপাল বণিক, ফরিদপুরের আলোচিত দুই ভাই সাজ্জাদ হোসেন বরকত ও ইমতিয়াজ হাসান রুবেলসহ প্রায় দুই শতাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলা আটকে আছে।

কালের কণ্ঠ

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধজালিয়াতি করে ১২০ কোটি টাকা নিয়ে ভারতে চম্পট হিন্দু দম্পতির
পরবর্তী নিবন্ধবৃদ্ধ মুসলিমকে উলঙ্গ করে পিটিয়ে নগদ অর্থ ও বিয়ের উপঢৌকন ছিনিয়ে নিয়েছে উগ্র হিন্দুরা