দারসে রমাদান।। দারস-২০।। জান্নাতের বৈশিষ্ট্য।।

0
156

আজকের মজলিসে আমরা জান্নাতের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাআলা কুরআনে কারীমে জান্নাতের অনেক বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন। জান্নাতের গুণাগুণ-সংক্রান্ত অনেক আয়াত নাজিল করেছেন। জান্নাতের হুরে ঈন, গাছপালা, প্রাসাদ ইত্যাদি আরও অনেক কিছুর গুণ বর্ণনা করেছেন। উলামাগণ বলেন, জান্নাতের নায-নেয়ামতের সারাংশ আল্লাহ তাআলা এই আয়াতে উল্লেখ করেছেন,
وَفِيهَا مَا تَشْتَهِيهِ الْأَنفُسُ وَتَلَذُّ الْأَعْيُنُ.
অর্থ: জান্নাতে মানুষের মনের এবং চোখের আকাঙ্ক্ষা ও তৃপ্তিদায়ক সবকিছু থাকবে।

এই মজলিসে মাত্র একটি হাদীস নিয়ে আলোচনা করব। আপনারা জানেন, আমাদের এই মজলিসগুলোতে নির্বাচিত কিছু বিষয়ের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বৈশিষ্ট্য ও তাৎপর্য আলোকপাত করার চেষ্টা করছি। আজকের মজলিসেও জান্নাতের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত একটি হাদিসের আলোচনা করেই মজলিসের ইতি টানব। প্রিয় ভাই, আপনাদেরকে জান্নাতের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে একটি কিতাব পড়তে উৎসাহ দিচ্ছি। কিতাবটির নাম “حادي الأرواح” “হাদিল আরওয়াহ”। উক্ত বিষয়ে কিতাবটি অনন্য। কিতাবের লেখক ইমাম ইবনু কাইয়্যিম রহিমাহুল্লাহ।

যে হাদিসটি নিয়ে আলোচনা করব সে হাদিসে জান্নাতের নায-নেয়ামতের বাস্তবতা পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে। সুবহানাল্লাহ! জান্নাতের নেয়ামত অন্তহীন। প্রতিদিন নতুন নতুন নেয়ামত ও নেয়ামতে নতুনত্ব আসবে। কল্পনা করুন! আপনি প্রতিমুহূর্তে, প্রতি মিনিটে জান্নাতের নেয়ামত ভোগ আর ভোগ করতে থাকবেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
“إذا دخل أهلُ الجنة الجنةَ نادى منادٍ يا أهل الجنة إن لكم…”
অর্থ: জান্নাতী ব্যক্তি যখন জান্নাতে প্রবেশ করবে তখন এক ফেরেশতা ডাক দিয়ে বলবে, হে জান্নাতের অধিবাসী, নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য…।
এরপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনুভূতি জাগ্রতকর চারটি বিষয় বর্ণনা করেছেন। বর্তমান পৃথিবীতে মানুষের কাছে এই চারটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বর্ণিত প্রথম বিষয়টি হচ্ছে-
“إن لكم أن تحيوا فلا تموتوا أبدًا…”
অর্থ: সেখানে তোমরা চিরকাল জীবিত থাকবে, কোনোদিন মৃত্যুবরণ করবে না।

আল্লাহু আকবার! জান্নাতে মৃত্যু নেই। জান্নাতে কোটি কোটি বছর স্বাধীনভাবে বিলাসিতা করবেন, আপনার মৃত্যু আসবে না। আপনাকে নিশ্চয়তা দেওয়া হবে যে, সেখানে মৃত্যু নেই। আপনারা জানেন, সকল প্রাণী একটি বিষয়ে আতঙ্কে থাকে, তার নাম মৃত্যু। মৃত্যুকে মানুষ খুবই ভয় করে। শুধু মুজাহিদগণ এর ব্যতিক্রম। সুবহানাল্লাহ! আল্লাহর পথের মুজাহিদগণ আগ্রহের সাথে শাহাদাতের মৃত্যু খুঁজে বেড়ায়। বিপরীতে জিহাদ না করে বসে থাকা লোকগুলো মৃত্যুর ভয়ে শঙ্কিত থাকে। আর মুজাহিদগণ আল্লাহ তাআলার মুলাকাত ও জান্নাত পাওয়ার আগ্রহে অধীর থাকে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই হাদিসে আপনাকে বলছেন, “সেখানে তোমরা চিরকাল জীবিত থাকবে, কোনোদিন মৃত্যুবরণ করবে না”। জান্নাতে মৃত্যু নেই। কেউ আপনাকে প্রশ্ন করতে পারে, জান্নাতবাসীরা কি ঘুমাবে? এটি গুরুত্বপূর্ণ ও অনুভূতিপ্রবণ প্রশ্ন, জান্নাতবাসীরা কি ঘুমাবে? উত্তর হচ্ছে, জান্নাতবাসীরা ঘুমাবে না। জান্নাতে কোনও ক্লান্তি নেই। তাই সেখানে ঘুমও নেই। কল্পনা করুন! একজন লোক কোটি কোটি বছর জান্নাতে ভোগ-বিলাসে মত্ত থাকবে। কোনোদিন ক্লান্ত হবে না, ঘুমাবে না। প্রশ্ন আসতে পারে, তা কীভাবে সম্ভব? আমি বলব, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা সবকিছু করতে সক্ষম। নিম্নের মূল্যবান মূলনীতিটি মুখস্থ করে নিন,
“أحوال الدنيا لا تُقاس بأحوال الآخرة”.
অর্থ: আখেরাতের অবস্থার সাথে দুনিয়ার অবস্থা অনুমান করা যায় না।

হাদিসে উল্লিখিত দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে,
“وإن لكم أن تصحّوا فلا تسقموا أبدًا”
অর্থ: সেখানে চিরকাল তোমরা সুস্থতা ও সুস্বাস্থ্য লাভ করবে, কোনোদিন অসুস্থ হবে না।
জান্নাতে কোনও অসুখ নেই। ছোট কোনও অসুখও আপনার হবে না। কল্পনা করুন! জান্নাতে ব্যাথা, সর্দি-কাশি, অ্যালার্জি ইত্যাদি কোনও অসুখ নেই। জান্নাতে আপনি বলবেন না যে, আমার পেট ব্যাথা করছে, পিঠে, কোমরে বা মাথায় ব্যাথা করছে। মোটকথা, সেখানে কোনও অসুখ থাকবে না। আপনি অসুস্থ হবেন না। আপনাকে গ্যারান্টি দেওয়া হবে যে, সেখানে কোটি কোটি বছর ভোগ-বিলাসে মত্ত থাকবেন, কিন্তু; কোনোদিন অসুস্থ হবেন না। যত প্রকারের রোগ আছে সকল রোগ থেকে মুক্ত থাকবেন। এই বিষয়টিও খুব গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ অসুখ-বিসুখ থেকেও সবসময় অনেক আতঙ্কে থাকে। ক্যান্সার, ডায়াবেটিস থেকে আতঙ্কে থাকে। আরও কত রোগ আছে। জান্নাতে কোনও রোগ থাকবে না। যা মনে চায় তা-ই পানাহার করতে পারবেন, অসুস্থ হবার কোনও ভয় থাকবে না।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বর্ণিত জান্নাতের তৃতীয় বিষয় হচ্ছে,
“وإن لكم أن تنعموا فلا تبأسوا أبدًا”
অর্থ: সেখানে তোমরা চিরকাল নেয়ামত লাভ করবে, কোনোদিন নিঃস্ব ও হতাশ হবে না।
জান্নাতে কোনও হতাশা নেই, চিন্তা-পেরেশানি নেই। সেখানে কেউ কটুকথা বলে আপনার মনে কষ্ট দেবে না। আপনার জন্য কষ্টকর ও দুশ্চিন্তার কারণ হবে এমন কোনও কাজ কেউ করবে না। সেখানে কষ্ট, দুশ্চিন্তা বলতে কিছু নেই। পূর্বে বলেছি, জান্নাতের নেয়ামত অফুরন্ত, অন্তহীন। জান্নাতে প্রতিমুহূর্ত, প্রতি মিনিট আপনি চাহিদাপূরণ, স্বাদ-ভোগ করা, সৌভাগ্যময় ও বন্ধুত্বের পরিবেশে আনন্দ-উল্লাসে কাটাবেন। চব্বিশ ঘণ্টা এভাবে কাটাবেন। পক্ষান্তরে জাহান্নামীরা চব্বিশ ঘণ্টা আযাবে পিষ্ট হবে। সেখানে কোনও শান্তি নেই। আল্লাহ তাআলার কাছে জাহান্নাম থেকে পানাহ চাই। আর জান্নাতীগণ চব্বিশ ঘণ্টা স্বাদ-ভোগে মত্ত থাকবে। পূর্বে বলেছি, জান্নাতে প্রতিদিন নতুন নতুন নেয়ামত ও নেয়ামতে নতুনত্ব আসবে। এই নেয়ামত দুনিয়ার নেয়ামতের মতো নয়। বরং সেখানে নিত্যনতুন নেয়ামতে ভরপুর থাকবে।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বর্ণিত জান্নাতের চতুর্থ বিষয় হচ্ছে,
“وإن لكم أن تشبّوا فلا تهرموا أبدًا”
অর্থ: সেখানে তোমরা চিরকাল যুবক থাকবে, কোনোদিন বৃদ্ধ হবে না। জান্নাতে কেউ বৃদ্ধ হবে না, অক্ষম হবে না। জান্নাতীগণের বয়স বাড়বে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জান্নাতীদের বয়সের ব্যাপারে বলেছেন, তাদের বয়স হবে ত্রিশ বা তেত্রিশ। আপনার বয়স থেমে থাকবে। আপনি কোটি কোটি বছর জান্নাতে বসবাস করবেন, তবুও আপনার বয়স ত্রিশ বা তেত্রিশে থেমে থাকবে, এরচেয়ে বাড়বে না। মানুষের যখন বয়স বেড়ে যায় তখন অসুখ বা মৃত্যুর ভয় অন্তরে জাগ্রত হতে থাকে। অক্ষমতা ও বয়োবৃদ্ধের আতঙ্ক তৈরি হতে থাকে। জান্নাতে কোনও বয়োবৃদ্ধ নেই, সেখানে কেউ বুড়ো হবে না। কেউ সেখানে অক্ষম হবে না।

এই চারটি বিষয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একই হাদিসে উল্লেখ করেছেন। আমাদের জন্য জান্নাতের বাস্তবতা সুস্পষ্ট করেছেন। প্রিয় ভাই, আমাদের উচিত সময়গুলো আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্যে কাটিয়ে জীবনকে কাজে লাগানো। যদি জান্নাতের প্রতি মানুষের আগ্রহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি হয় তাহলে সে নেক কাজ করবে এবং মন্দ কাজ ত্যাগ করবে। তখন আল্লাহ তাআলা অনুগ্রহ করে জান্নাতে প্রবেশের তাওফীক দান করবেন।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে জান্নাতের গুণ ও বৈশিষ্ট্য জেনে এর প্রতি আগ্রহী হওয়ার তাওফীক দান করুন। জান্নাতের অন্তহীন নেয়ামত দান করুন, আমীন।


মূল: শায়খ খালিদ আল-হুসাইনান (আবু যায়েদ কুয়েতি) রহমাতুল্লাহি আলাইহি
অনুবাদ: আল-ফিরদাউস টিম

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধফটো রিপোর্ট || ইসরায়েলি অভিযানে ধ্বংসস্তূপ গাজার আল-শিফা হাসপাতাল
পরবর্তী নিবন্ধভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলিতে আরও এক বাংলাদেশি নিহত